ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চিত্র পাল্টাচ্ছে নিত্য

পদ্মা সেতু নির্মাণে বাড়ছে কাজের গতি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ এপ্রিল ২০১৬

পদ্মা সেতু নির্মাণে বাড়ছে কাজের গতি

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মায় পানি বাড়ছেই। গত ১৫ দিনে দেড় মিটার পানি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্রোতও। কিন্তু তাতে কী সব উপেক্ষা করে প্রবল গতিতে চলছে সেতু বন্ধনের কাজ। বিশাল এই নির্মাণযজ্ঞে চিত্র পাল্টাচ্ছে নিত্য। আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এই সেতুর ৩টি স্প্যান তৈরি হয়ে গেছে। স্প্যানগুলো তৈরি হচ্ছে চীনে। আগামী নবেম্বর নাগাদ স্প্যান তিনটি প্রকল্প এলাকায় পৌঁছবে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে এই তিন স্প্যান বসবে জাজিরা প্রান্তের ৩৯, ৩৮ ও ৩৭ নাম্বার পিলারে। বিস্ময়কর এই পদ্মা সেতু কর্মযজ্ঞ সরেজমিন দেখতে আজ শনিবার ভারতীয় হাই কমিশনার আসছেন। সঙ্গে সেতুমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ থাকছেন। শুক্রবার পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সরেজমিন পরিদর্শন এবং তিন দিনব্যাপী সভা শেষ করেছে গত ১০ এপ্রিল। এই প্যানেলের অবজারভেশন অনুযায়ী কাজের গতি ক্রমেই বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগে নদী শাসনের বিশেষ গতি বলবত হয়েছে। নদী শাসনে এই সময় পর্যন্ত টার্গেট ছিল ২১ শতাংশ। তবে নানা কারণে একটু পিছিয়ে এখন রয়েছে। বর্তমানে নদী শাসনের অগ্রগতি প্রায় ১৯ শতাংশ। ঘূর্ণি স্রোতের কারণে নদীর তলদেশে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তাই সেখানে বিশেষ প্লাস্টিক বেগ পদ্মায় ফেলা হচ্ছে। এছাড়া ড্রেজিং চলছে। চলছে ব্লক স্থাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। মাওয়া প্রান্তের দেড় কিলোমিটার বেঁধে ফেলা হবে ব্লকে। সেতুটির পাইলিংয়ের কাজেও গতি এসেছে। এ্যাপ্রোচসহ সব প্যাকেজেই কাজ চলছে দূরন্ত গতিতে। ভারি ভারি নির্মাণ যন্ত্র চলছে রাত দিন। পদ্মা সেতুর পাঁচটি প্যাকেজই মূল্যায়ন করেছে বিশেষজ্ঞ টিম। তবে মূল সেতুকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি যোগ দেয়া ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট গতি বাড়াতে কাজ চলছে। মাওয়া প্রান্তের মতো জাজিরা প্রান্তেও এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। পদ্মাজুড়ে কর্মযজ্ঞ ছাড়াও তীরের কাজও চলছে সমান তালে। দু’পারের এ্যাপ্রোচ এবং সার্ভিস এরিয়া-২ এর অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ। সেতু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেতুর কাজের গতিতে তারা সন্তুষ্ট। প্রায়শই আকস্মিক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতুস্থল পরিদর্শন করছেন। স্থানীয় সাংসদ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এবং জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল সময় সময় পরিদর্শন করছেন। কাওড়াকান্দি ফেরিঘাট কাঁঠালবাড়ি ঘাটে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তাই কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে খুলনা সড়কে যোগাযোগের সুবিধার্থে নবনির্মিত পদ্মা সেতুর ৮ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ রোড খুলে দেয়ার উপযোগী করার কাজও এগিয়ে চলছে। এই কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের জানিয়েছেন, ৩৭ নাম্বার পিলারের মঞ্চ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। ২-৪ দিনের মধ্যেই পাইল স্থাপনের কাজ শুরু হবে। এদিকে জাজিরা প্রান্তে ৩৯ নাম্বার পিলারে ৩টি পাইল ৭০ মিটার গভীরে স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নাম্বার পিলারেও অনুরূপ ৩টি করে ৬টি পাইল নদীর তলদেশের ৭০ মিটার গভীর পর্যন্ত স্থাপন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ৯টি পাইল স্থাপন হয়েছে। এর ওপর প্রতিটিতে আরও প্রায় ৫০ মিটার করে স্থাপন করা হবে। তখনই প্রতিটি পিলারের বাকি ৩টি করে পাইল ড্রাইভ করা যাবে। এদিকে ৩৮ ও ৩৯ নাম্বার পিলারের মাঝে ট্রায়াল পাইল স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে বুধবার। পাইলের ভেতরের বালু সরিয়ে সেখানে কংক্রিটের ঢালাই দেয়া হয়েছে। এই দিন থেকে ২১ দিন শেষ হলে লোড টেস্ট করা হবে। এই লোড ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে মাওয়া প্রান্তেও আরেকটি ট্রায়াল পাইল এর আগেই স্থাপন হয়েছিল। সেতুর ৪২টি পিলারের জন্য মোট দু’টি ট্রায়াল পাইল এবং ১০টি টেস্টিং পাইল স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। দু’টি ট্রায়াল পাইল এবং ৬টি টেস্টিং পাইল স্থাপন হয়েছে। বাকি ৪টি টেস্টিং পাইল পর্যায়ক্রমে স্থান করা হবে। পিলারের ওপর বসবে সেতুর স্লাব ও ট্রাস। চীনে সøাব ও ট্রাস তৈরি চলছে পুরোদমে। পর্যায়ক্রমে পিলার তৈরি হবে আর সেখানে সøাব ও ট্রাস জুড়ে দেয়া হবে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিলার, যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬টি পাইল। এই সেতু বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেবে। সেতু সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্বের বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর অন্যতম পদ্মায় সেতু তৈরি এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ সফল করতে চলছে বিরাটযজ্ঞ। এই নদীর দু’তীরকে সেতুতে বন্ধন তৈরি করতে বিশ্বের চৌকস বিশেষজ্ঞরা কাজ করছে। পদ্মার যে স্থানে সেতুটি নির্মিত হবে সেখানে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ছয় দশমিক পনেরো কিলোমিটার। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার কোন নদীর ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু। পদ্মা সেতু শুধু সড়ক সেতু নয়। একই সঙ্গে এই সেতুর ওপর দিয়ে যাবে ট্রেন। এছাড়াও যাবে গ্যাস পাইপ লাইন এবং বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন। দুই তলা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে গাড়ি আর সেতুর নিচের লেভেলে থাকবে ট্রেন লাইন। পদ্মা এক অস্থির নদী। দুই তীরে ভাঙ্গাগড়া চলে প্রতি বছর। বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে স্রোতের বেগ এত বেশি থাকে যে, সেতুর নকশা করার সময় প্রকৌশলীদের কাছে এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্র-দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি। উজান থেকে নেমে আসা এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে সেতুটিকে। তাই নদীর দুই তীরে নদী শাসনে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে এই দুই নদী। বলা যেতে পারে এই দুই নদীর পলি জমেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অনেকখানি অঞ্চল। এই সেতুর নক্সা করার ক্ষেত্রে এই নদীবাহিত পলির বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে এমন এক অঞ্চলে যেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও আছে। এ নিয়ে সেতুর নক্সা তৈরির আগে বিস্তর সমীক্ষা করা হয়েছে। সেতুর নক্সাটিকে এজন্য ভূমিকম্প সহনীয় করতে হয়েছে। নদী শাসনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে কংক্রিটের ব্লক। পদ্মা সেতুর ভিত্তির জন্য পাইলিং এতটা গভীরে গিয়ে সেতুর জন্য পাইলিংয়ের নজির খুব কম। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার করলী চরে সাবলিম্যানাটারি কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড সম্পন্ন হয়েছে। তাই গত বুধবার সেখানে কর্মরত লোকজন উঠেছে। এই ইয়ার্ড থেকেই এখন ৩৭ নাম্বার পিলারের কাজ চলছে।
×