ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজিম খুনের নেপথ্যে জঙ্গী সংগঠনের স্লিপার সেল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ এপ্রিল ২০১৬

নাজিম খুনের নেপথ্যে জঙ্গী সংগঠনের স্লিপার সেল

শংকর কুমার দে ॥ টার্গেট নিদিষ্ট করে খুনের মিশনে নেমেছে জঙ্গী সংগঠনগুলোর ‘সিøপার সেল’। একেকটি জঙ্গী সংগঠনের শতাধিক সিøপার সেল সদস্য রয়েছে, যাদেরকে হত্যাকা-ে অংশগ্রহণে নানা প্রলোভনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারী সিøপার সেলের সদস্যদের কেউ ধরা পড়লেও যাতে একে অপরকে আড়াল করা যায় সেজন্য তারা থাকে অচেনা, অপরিচিত। উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ সংগঠন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ৮৪ জনের হিট লিস্টের তালিকা থেকে একের পর এক খুন করা হচ্ছে প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও মুক্ত চিন্তার ধারক-বাহক ব্যক্তিদের। খুনের তালিকায় বুধবার রাতে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ। রাজধানীর সূত্রাপুরে সাতাশ বছরের নাজিমকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে উধাও হয়ে গেছে জঙ্গী গোষ্ঠীর সিøপার সেলের সদস্য খুনীচক্র। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অনলাইন এক্টিভিস্ট বা ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০১৩ সালে ৮৪ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। তালিকায় থাকা ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হলে অন্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ হয় সরকার। তারপরেও আবার ওই তালিকার ৮০ নম্বরে থাকা নীলাদ্রি খুন হয়। এখন দেখা যাচ্ছে তালিকার বাইরে থেকেও খুন হচ্ছে যারা নির্দিষ্ট টার্গেট কিলিং রয়ে গেছে। গত আড়াই বছরে অন্তত এক ডজন ব্লগার খুন হয়েছেন, যার একটিরও বিচার হয়নি অদ্যাবধি। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় খুন হওয়ার পরে আবারও খুন হলেন নাজিম। উইকিপিডিয়াতে সিøপার সেল সম্পর্কে বলা আছে, এরা এমন একদল মানুষ, যারা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কোন সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকা- করে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীতে সিøপার সেল গঠন করে অপারেশন চালানোর ঘটনা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে সর্বপ্রথম ভিয়েতনামে সরকারের বিরুদ্ধে সিøপার সেল অপারেশন চালানো হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট অব লিবারেশন (এনএফএল)’ নামে একটি সংগঠন এই সেল গঠন করে অপারেশন চালিয়েছিল। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়দা মধ্যপ্রাচ্যে এইভাবে হামলা চালিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে এ ধরনের সিøপার সেল গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, জঙ্গী সংগঠনগুলোর সিøপার সেলে কমপক্ষে ৫ থেকে সর্বোচ্চ সাত জন সদস্য থাকে। এদের মধ্যে একজন দলনেতা থাকে। হত্যা মিশনের শুরুতে তাদের প্রত্যেককে একে অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মূল পরিকল্পনাকারী। দলনেতাই প্রত্যেক সদস্যকে মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়- কাকে, কীভাবে খুন করতে হবে। খুনের টার্গেট করা ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে রেকি করা হয়। পরিকল্পনাকারী নিজেই সেলের সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহ করে। তারা বেশিরভাগ সময় ধারালো চাপাতিসহ ছোরা জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে। কুপিয়ে বা গলা কেটে হত্যার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের ইনজেকশনও ব্যবহার করে তারা। সিøপার সেলের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশের ক্ষেত্রে জেএমবি সদস্যরা গোপন আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ঠিকানা ব্যবহার করছে। ঢাকার মিরপুরের মণিপুর স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষককে হত্যার জন্য সিøপার সেলের সদস্যদের গোপন আইপি ঠিকানার একটি ওয়েবসাইট থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ওই ওয়েবসাইটে ঢোকার জন্য সেলের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। ওই দুই শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়ে সিøপার সেল সদস্য রুবেল গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। ব্যর্থ হয় ওই হত্যা মিশন। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠনগুলো সিøপার সেল গঠন করে এ ধরনের হত্যা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীরসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে শতাধিক সিøপার সেল সক্রিয় রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ব্লগার হত্যাকারীরা মোবাইল ব্যবহার করে না। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হত্যার কথোপকথন হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান কৌশল কোন কাজে আসছে না। ব্লগারদের টার্গেট করে তারা ফেসবুক ও টুইটারে ছবিতে লাল ক্রসচিহ্ন দিয়ে পোস্ট দিচ্ছে। পরবর্তীকালে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই সিøপার সেলের সদস্যরা ধরা পড়ছে না কিংবা কেউ ধরা পড়লেও তাদের সহযোগী সদস্যরা ধরা পড়ছে না। এ জন্যই গত ৩০ মার্চ রাজধানীর হাতিরঝিলের বেগুনবাড়িতে দিনের বেলায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে পালানোর সময় একজন হিজরা জিকরুল্লাহ ওরফে জিকির (২০) ও আরিফুর রহমান (১৯) নামে দুইজনকে আটক করে। আটককৃতদের একজন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। অপরজন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার ছাত্র। হাতেনাতে দুই জন ধরা পড়ার পর দফায় দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেও খুনী চক্রের অপর সহযোগীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা যায়নি, মামলার তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে রাজধানীর পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে হত্যা করার ঘটনায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়ার পর মামলাটি আদালতে এখনও আদালতে বিচারাধীন। গত আড়াই বছরে যে অন্তত এক ডজন ব্লগার খুন হয়েছেন তার মধ্যে নীলাদ্রি, ওয়াশিকুর ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত রায়, যার খুনের তদন্তে ঢাকায় এসে তদন্ত করে আলামত, ডিএনএ নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়কে হত্যা ও স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে গুরুতর আহত করা হয়। এখনও খুনের তদন্তের অগ্রগতি যেই তিমিরে ছিল সেইখানেই রয়ে গেছে। এরই মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিত রায়ের গ্রন্থের প্রকাশক ও জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। একই দিন প্রায় একই সময়ে রাজধানীর লালমাটিয়ায় কুপিয়ে আহত করা হয় অভিজিত রায়ের গ্রন্থের অন্য প্রকাশক ও শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার-লেখক রণদীপম বসু ও তরুণ কবি তারেক রহিমকে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, একই কায়দায় কুপিয়ে গুলি করে একের পর এক হত্যা করে মোটর সাইকেলযোগে ইসলামের ধনি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর খুনী চক্রকে চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে ধরা যাচ্ছে না। গত বছরের ৯ এপ্রিল দিনদুপুরে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আবাসিক ছাত্র ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে হত্যাকারী বুয়েট ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারের পর মেজবাহ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগুচ্ছে না। কারণ খুনী চক্রের সদস্যরা জঙ্গী সংগঠনগুলোর সিøপার সেলের সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা জঙ্গী গোষ্ঠীর খুনী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করতে পারছে না, কেউ কাউকে চিনে না, তারা সিøপার সেলের সদস্য।
×