ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের একটি প্রতিনিধি দল;###;মুখ খুলবেন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী অং

আগামী সপ্তাহে ফিলিপিন্স শ্রীলঙ্কা ও যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে সিআইডি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৯ মার্চ ২০১৬

আগামী সপ্তাহে ফিলিপিন্স শ্রীলঙ্কা ও যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে সিআইডি

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে আগামী সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপিন্সে যাচ্ছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। ওই দেশের তদন্ত টিমের সহায়তায় অপরাধী চিহ্নিত এবং চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সহজ হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে আসছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল একশন ট্রাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) একটি প্রতিনিধি দল। একই সঙ্গে তাদের অপর একটি প্রতিনিধি দল এই ঘটনা তদন্ত করতে ফিলিপিন্সেও যাবে। আগামী মে মাসে তাদের এই প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। অন্যদিকে আজ মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সিনেট ব্লু রিবন কমিটির তৃতীয় শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির বিষয়ে মুখ খুলবেন মূল হোতা চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী কিম অং। ফলে এই ঘটনায় দেশটির ‘রাঘববোয়লাদে’র নাম বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়া এই ঘটনায় হ্যাকার ছাড়াও কোন দেশের কত নাগরিক জড়িত তা বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করছে সিনেট কমিটি। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮০০ কোটি টাকা অর্থ লোপাটের ঘটনায় অধিকতর তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। সিআইডির পাশাপাশি র‌্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ও পুলিশের বিশেষ শাখাসহ (এসবি) অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য ও সংগৃহিত আলামতের চূড়ান্ত পর্যালোচনা শুরু করছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে আগামী সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপিন্সে যাচ্ছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। ওই দেশের তদন্ত টিমের সহায়তায় অপরাধী চিহ্নিত এবং চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সহজ হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের ঘটনা একটি ট্রান্সন্যাশনাল (আন্তঃদেশীয়) অপরাধ। প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত অন্তত ১৫ বিদেশীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে বলে তিনি জানান। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের পর সিআইডি টিম আগামী সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপিন্সে যাবে। এজন্য আদালতের অনুমতি চাওয়ার প্রক্রিয়াসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষের পথে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ অর্থই ফিলিপিন্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এজন্য ফিলিপিন্স পুলিশও ঘটনার তদন্ত করছে। এজন্য ফিলিপিন্স পুলিশ ও সিআইডির তথ্য সমন্বয় করলে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সহজ হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে জানান, তদন্তের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু কি ধরনের অগ্রগতি হয়েছে তা বলতে চাননি এই কর্মকর্তা। এদিকে রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে আসছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল একশন ট্রাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) একটি প্রতিনিধি দল। একই সঙ্গে তাদের অপর একটি প্রতিনিধি দল এই ঘটনা তদন্ত করতে ফিলিপিন্সেও যাবে। আগামী মে মাসে তাদের এই প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, তারা যদি রিজার্ভের ঘটনাটি দেখতে চায় তাহলে তো দেখতেই পারে। কেননা মানিলন্ডারিং-বিষয়ক সব কিছুই তারা দেখতে পারে। তবে তারা এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করব। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার চুরির ঘটনার পর এ বিষয়ে মানিলন্ডারিং-বিষয়ক এগমন্ট গ্রুপ ও এপিজি থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফিলিপিন্সের কাছে চাওয়া হচ্ছে। তাদের চাহিদা মতো সব তথ্যের যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যেও যোগাযোগ হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এগমন্ট গ্রুপ ও এপিজির কাছে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। তবে তারা বিষয়টিকে সুইফট সার্ভার হ্যাক বলেই উল্লেখ করেছে। চুরি রিজার্ভ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তারা ওই দুই সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছে। আজ রিজার্ভ জালিয়াতির পুরো ঘটনা বর্ণনা করবেন হোতা নিজেই ॥ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানিলন্ডারিংয়ে ফিলিপিন্সের ব্যবসায়ী কিম অং-কে মূল হোতা বলে মনে করা হচ্ছে। এ ব্যবসায়ীই মূলত আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপককে পাঁচটি এ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছিলেন, যার চারটিতে বাংলাদেশের চুরি হওয়া আট কোটি ১০ লাখ ডলার জমা হয়। আর এ অর্থ স্থানীয় মুদ্রা পেসোতে রূপান্তর করতে রেমিট্যান্স কোম্পানি ফিলরেমের কাছে পাঠাতেও বলেছিলেন কিম অং। আজ মঙ্গলবার সে দেশের সিনেট ব্লু রিবন কমিটির তৃতীয় শুনানিতে এ বিষয়ে খোলার মুখ কথা রয়েছে চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী কিম অংয়ের। দেশটির নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন, তার জবানবন্দীতে দেশটির ‘রাঘববোয়ালদে’র নাম বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়া এই ঘটনায় হ্যাকার ছাড়াও কোন দেশের কতজন নাগরিক জড়িত তাও বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজকের সিনেট কমিটির শুনানিকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের গোটা ব্যাংকিং খাতের নজর এখন ফিলিপিন্সের দিকে। ফিলিপিন্স সিনেটের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রাবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সার্জ ওসমেনা সম্প্রতি বলেছেন, এ ঘটনায় একজন মূল পরিকল্পনাকারী আছে। মনে হচ্ছে, সেই ব্যক্তি কিম অং। সে-ই (অং) এখানে বড় খেলোয়াড়। দেগুইতো কেন অংয়ের কথায় এ্যাকাউন্ট খুললেন জানতে চাইলে ওসমেনা বলেন, তারা একে অন্যকে চিনতেন। মাইডাস নামে এক হোটেলে তারা বৈঠক করেন এবং ওই পাঁচটি হিসাবের বিপরীতে প্রয়োজনীয় তথ্য দেন অং। এ্যাকাউন্টগুলোর পরিচয়দানকারী অং নিজেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, আরসিবিসি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের নিয়ম-কানুন ঠিকমতো অনুসরণ করলে পাচার হওয়া ওই অর্থ আটকানো যেত। ঘটনা জানার পর পরই বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ ফেব্রুয়ারি এসব পেমেন্ট স্থগিত করতে আরসিবিসিকে অনুরোধ জানায়। আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষ করে শাখা ব্যবস্থাপক ইচ্ছা করলে ওই তহবিল আটকাতে পারতেন। কিন্তু তারা তা না করে চুরির অর্থ অন্য জায়গায় স্থানান্তরে সহায়তা করেছেন। ফিলিপিন্সের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, যে চারজনের এ্যাকাউন্টে পাচার করা টাকা ঢোকে তারা সবাই ৫০০ ডলার করে জমা রাখে আরসিবিসির এ্যাকাউন্টে। একই সঙ্গে আরেকটি এ্যাকাউন্ট খোলা হয়, যাতে বাংলাদেশের চুরির অর্থ জমা হয়নি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই পাঁচ এ্যাকাউন্টে কোন লেনদেন হয়নি। এসব এ্যাকাউন্ট মূলত ভুয়া। হিসাবধারীদের ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এদিকে আজ মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সিনেট ব্লু রিবন কমিটির তৃতীয় শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির বিষয়ে মুখ খুলবেন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিন্সের ব্যবসায়ী। এতে এই ঘটনায় দেশটির ‘রাঘববো-য়ালদে’র নাম বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া এই ঘটনায় হ্যাকার ছাড়াও কোন দেশের কতজন নাগরিক জড়িত তা বেরিয়ে আসতে পারে। এর আগে সোমবার দেশটির সংবাদ মাধ্যম দ্য ইনকোয়্যারারকে এ সংক্রান্ত তথ্য জানান সাবেক সিনেটর প্যানফিলো ল্যাকসন। দেশটির একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, শুনানিতে এখন পর্যন্ত উঠে আসা বিভিন্ন তথ্যের জট খুলতে অংয়ের বক্তব্য কাজে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিনেটর প্যানফিলো ল্যাকসন বলেন, আমার পরামর্শ অনুযায়ী অং মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় সিনেটের শুনানিতে সবকিছু বিস্তারিত জানাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। উল্লেখ্য, সাবেক এ সিনেটর ও কিম অং দীর্ঘদিনের বন্ধু। কিম অংয়ের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ফিলিপিন্সের বিচার বিভাগে অর্থ পাচারে সহায়তার অভিযোগে মামলা করেছে দেশটির এ্যান্টি-মানিলন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি)। গত সপ্তাহে তিনি সিঙ্গাপুরে মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে ফিলিপিন্সে ফিরেছেন। দেশে ফিরেই তিনি তার আইনজীবীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার জানা সবকিছু সিনেটের সামনে তুলে ধরতে প্রস্তুত আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে চুরিকৃত ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার স্ট্রিট শাখার চারটি এ্যাকাউন্টে জমা হয়। পরে ওই অর্থ কয়েক হাত ঘুরে ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গো, জু ওয়েইক্যাং ও কিম অংয়ের কাছে পৌঁছায়। চুরি যাওয়া অর্থ থেকে কিম অং পান ২ কোটি ১০ লাখ ডলার। আরসিবিসির ওই শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দাগুইতো ওই চার এ্যাকাউন্ট খোলার সঙ্গে কিম অংয়ের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সিনেটে তুলে ধরেন। দাগুইতোর বক্তব্য অনুযায়ী, কিম ভুয়া পরিচয়পত্রের বিপরীতে ওই চারটি সন্দেহভাজন এ্যাকাউন্ট তাকে খুলতে বলেছিলেন। ল্যাকসন বলেন, কিম অং কিছু তথ্য তুলে ধরবেন। পাশাপাশি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেয়া ভুল তথ্য সংশোধনেও তার বক্তব্য ভূমিকা রাখবে। আমি তাকে বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করতে বলেছি। ল্যাকসন ফিলিপিন্সের জাতীয় পুলিশ বাহিনীর প্রধান থাকাকালে কিম অংয়ের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়। কিম সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার জানামতে কিম কোন অপরাধ কর্মে লিপ্ত নয়। আর মাদক বা অর্থ পাচারের সঙ্গে সংযুক্তি তো অনেক পরের বিষয়। না হলে তাকে আমি নিজেই গ্রেফতার করতাম।
×