ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

জনতার মঞ্চ-ফিরে দেখা

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৯ মার্চ ২০১৬

জনতার মঞ্চ-ফিরে দেখা

দ্বিতীয় অংশ এই পরিস্থিতিতেও খালেদা জিয়া নির্লজ্জভাবে একদিন-দুদিন পর পর ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে যান। ২৫ মার্চ ২৮ জন অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও অতিরিক্ত সচিব এক বিবৃতিতে জনতার দাবি সমর্থন করে ’৭১ সালের মতো অবৈধ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের বিবেকের প্রতি সাড়া দিয়ে জনগণের সঙ্গে একাত্মতা নিয়ে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীর এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এই বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক সচিব মফিজুর রহমান, এসএএমএস কিবরিয়া, এএমএ মুহিত, এবিএম গোলাম মোস্তফা, এএসএইচকে সাদেক, ফারুক আহমেদ চৌধুরী, কাজী আজহার আলী, খন্দকার আসাদুজ্জামান ও এইচটি ইমাম, এটিএম শামসুল হক, লুৎফুল মতিন, মীর্জা আবদুল জলিল এবং সাবেক আইজি রকিব খন্দকার। সেদিন দুপুরে বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারুক সোবহানের নেতৃত্বে জনতার মঞ্চে উত্থাপিত দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। জনতার মঞ্চকে কেন্দ্র করে জনগণের দাবি উত্তাল হয়ে সাআদেশে ছড়িয়ে পড়ে, অধিকার প্রতিষ্ঠার সারথীর ভূমিকায় জনতার মঞ্চ এগিয়ে চলে। দেশব্যাপী এইরূপ উত্তাল অসহযোগ ও দাবির প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া তথাকথিত নির্বাচিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত খসড়া আইন উত্থাপন করেন বলে সন্ধ্যায় আমরা সংবাদ পাই। ২৬ মার্চ আমরা সচিবালয়ে আবার সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমাবেশ করি। এই সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ আহমদ, যোগাযোগ সচিব ওয়ালিউল ইসলাম, স্থানীয় সরকার সচিব আলমগীর ফারুক চৌধুরী ও তথ্য সচিব সৈয়দ আমীর উল মুল্ক। সভায় সভাপতিত্ব করেন সচিবালয়ের কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি সৈয়দ মহীউদ্দীন। কর্মকর্তাদের মাঝ থেকে বক্তব্য দেন যুগ্ম সচিব সিরাজ উদ্দিন আহমদ এবং উপ-সচিব আবদুল হাই, খান মোহাম্মদ বেলায়েত ও বীর বিক্রম শাজাহান সিদ্দিকী। আমি সকলের পক্ষ থেকে আমার বক্তৃতায় ২৭ মার্চের মধ্যে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং তার আগেই সচিবালয় থেকে বিডিআরসহ সকল নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারকরণের দাবি জানাই। এই সভায় প্রতিবাদী কর্মচারী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের বার্তাবাহক ইমরুল কায়েস ও আবদুর রাজ্জাক এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী মাজেদুল হক- যাদের আগের রাতে বিএনপির লেলিয়ে দেয়া গু-ারা আহত করেছিল- রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হলে তৎকালীন অবৈধ শাসকদের প্রতিবাদ ও প্রতিকূলে উপস্থিত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী থু থু ছিটিয়ে ঘৃণা ব্যক্ত করেন। শোক ও নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয় পুরনো ঢাকার আওয়ামী লীগ কর্মী ও শ্রমিক বশির উদ্দীনের মৃত্যুতে। বশিরকে বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মীরা দুপুরে বাদামতলীতে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বলে আমরা জানতে পারি। সচিবালয়ে সভা শেষে আমরা একযোগে জনতার মঞ্চে যোগ দেই। সেখানে বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির প্রতিনিধিরা বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সকলে খালেদা জিয়া সরকারের পদচ্যুতি, বিচার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিকে সোচ্চার করেন। এই দিন তেজগাঁও, ডেমরা ও পোস্তগোলা এলাকা থেকে জনতার মঞ্চের সামনে এসে শ্রমিকরা অবস্থান নেন ও মঞ্চে উত্থাপিত দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সন্ধ্যায় এ মঞ্চ থেকে বক্তৃতা ও ঘোষণার ফাঁকে ফাঁকে গাওয়া হয় দেশাত্মবোধক গান, আবৃত্তি করা হয় জনউদ্দীপনামূলক কবিতা। এই সন্ধ্যায় সমবেতভাবে গাওয়া ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ প্রেসক্লাবের চত্বর থেকে নগরের প্রায় সব জায়গায় নব উদ্দীপনার ধারক ও বাহক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ মার্চ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির প্রেক্ষাপটে এবং জনতার মঞ্চের সঙ্গে একীভূত প্রজাতন্ত্রের সকল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির মুখে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব আয়ুবুর রহমান ও প্রশাসন সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আতাউল হকের নেতৃত্বে প্রায় ২০ জন সচিব তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাত করেন। এদের সঙ্গে আমি এবং সফিউর রহমান (তৎকালীন পাট সচিব) উপস্থিত ছিলাম। আমরা একবাক্যে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ও প্রশাসনকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে (১) খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগ ও (২) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানকে যুক্তিযুক্ত সমাধান বলে উপস্থাপিত করি। রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস আমাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেন এবং বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য এক সমাধানে আসার চেষ্টা তিনি করবেন। আমি ফিরে এসে জনতার মঞ্চে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এই মর্মে অবহিত করি এবং সকল পর্যায়ের অধিদফতর, পরিদফতর, বিভাগীয় ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অটল থেকে দ্রুততম গতিতে সমস্যা সমাধানের আশা নিয়ে তাদের স্ব স্ব পর্যায়ে মৌল প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সংহত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী কার্যক্রমের সামনে উদ্ভূত বাধা-বিঘœ দূর করতে নির্দেশনা দেই। এই রাতে জনতার মঞ্চে মেয়র হানিফ ঘোষণা করেন যে, অবৈধ সরকারের সঙ্গে কোন আপস চলবে না। তার কাছে দুপুরে বিএনপির ৩ মন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপসের প্রস্তাব নিয়ে দেখা করেছিলেন। এই দিনকার সমাবেশে জনতার মঞ্চ থেকে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ যারা করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাইমা আলী, শামা রহমান ও নাদিরা বেগম। রাত ১২টার পর সমবেতভাবে আমরা গেয়ে উঠি ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ মঞ্চে বসে থাকা আমাদের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে এসে উৎসাহ দিয়েছিলেন নারী নেত্রী হোসনে আরা ও মিনু চৌধুরী। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×