ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা

ষড়যন্ত্র চলছে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ মার্চ ২০১৬

ষড়যন্ত্র চলছে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দেশ যখন সবক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে তখন সরকারকে বাধা ও ব্যতিব্যস্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। পরাজিত শক্তির দোসরদের দেশের উন্নয়ন ভাল লাগে না। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, ‘৭৫-এর খুনীদের দোসর এবং যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা থেমে থাকবে না এটিই স্বাভাবিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, নিয়ে যাবই। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘বাঙালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। দীর্ঘ ২১টি বছর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু বাঙালী জাতিকে দাবায়ে রাখতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।’ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন নেত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলেন। কিন্তু তাঁর মুখ ছিল করুণ, কোন হাসি ছিল না। হাসি থাকবে কোত্থেকে? তাঁর পেয়ারের যুদ্ধাপরাধীদের একে একে ফাঁসি হচ্ছে, শাস্তি হচ্ছে। তাঁর প্রতি দেশের জনগণের কোন সমর্থন নেই। দেশের জনগণকে যখন উনি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করেন, তখন তাঁর মুখে হায়েনার মতো হাসি ফোটে। তাই এখন তাঁর মুখে কোন হাসি নেই। কারণ ওনার হৃদয়ে তো পেয়ারে পাকিস্তান! পাকিস্তান বেকায়দায় থাকলে ওনার মুখ করুণ হয়, কোন হাসি থাকে না। রবিবার বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সতীশ চন্দ্র রায়, মাহবুবউল আলম হানিফ, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, ডাঃ দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন, ডাঃ বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু ও রাজশাহীর সাবেক মেয়র এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে। দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এ নির্বাচনেও বিএনপির তেমন গরজ নেই। তারা শুধু নানা কথার মাধ্যমে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে, সারাদিন নালিশ করে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ নির্বাচনেও তারা জনগণের সমর্থন পাচ্ছে না। তাদের জ্বালাও-পোড়াও ও মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার রাজনীতি দেশের জনগণ মেনে নেয়নি। আসলে বিএনপি নেত্রী যেভাবে নির্বিচারে জ্বালাও-পোড়াও ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে এটা কোনভাবেই আন্দোলন নয়, এটি ছিল সম্পূর্ণ হত্যাকা-। এ কারণেই জনগণ তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলব। কারও কাছে মাথানত করব না। ভিক্ষা করে চলব না। নিজেদের আয়-সামর্থ্য দিয়ে চলব। নিজেদের সৎপথের পয়সায় ডাল আর মোটা চালের ভাত খাব, ভিক্ষা করে বা কারোর কাছে হাত পেতে বিরিয়ানি খাব না। দেশের মানুষকেও এমন আত্মবিশ্বাস নিয়েই কাজ করে যেতে হবে। ’৭৫ পরবর্তী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছেÑ তখনই জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ওই সময় কারা কাদের মদদে এবং টাকা নিয়ে এসব করেছে তা এখন গবেষণার বিষয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী জিয়াউর রহমান একাত্তরের গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে তাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একটি প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতেই দেয়নি। পরাজিত শক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে ২১টি বছর দেশের জনগণকে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। ১৮-১৯টি ক্যুর ঘটনায় সব মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারকে হত্যা করেছে। দেশের কোন মানুষের মধ্যে শান্তি ও আশা ছিল না। প্রতিদিন আতঙ্কের মধ্য দিয়ে তাদের চলতে হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। দেশের নতুন প্রজন্ম এখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ৫ বছরের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর পাঁচটি বছর বিএনপি-জামায়াত জোট একাত্তরের মতো দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। মা-বোনদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে। ৬ বছরের শিশু রজুফাও তাদের প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি। জেনারেল জিয়ার মতো তাঁর স্ত্রীও যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের হাতে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল। ক্ষমতায় থেকে তারা নিজেরা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে, কিন্তু দেশের জনগণ কিছু পায়নি। তাদের ৫ বছরের দুঃশাসন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গীবাদ সৃষ্টির কারণেই পরবর্তীতে ওয়ান ইলেভেন এসেছিল। ওই সময় দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মহার্ঘ স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইসব দেশে বহির্বিশ্বের যেসব দেশ মিত্র বাহিনী দিয়ে সহযোগিতা করেছে, পরবর্তীতে তারাই ওই দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। মিত্রবাহিনী সে সব দেশে এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম দেশ যেখানে মিত্রবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসেনি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্বাধীনচেতা মনোভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ভারতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মিত্রবাহিনীকে দেশে ফিরে নেয়ার কথা বলেছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধীও স্বাধীনচেতা নেত্রী ছিলেন বলেই স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনী নিজ দেশে ফিরে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ়চেতা নেতা ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা ও আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় বাহিনীর সদস্যদের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী দলের সব নেতাকর্মীকে ভালভাবে পড়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন স্বাধীনতার জন্য কী কী করতে হবে। দেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সত্তরের ম্যান্ডেট আর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। তাঁকে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণারও ক্ষমতা দিয়েছিল দেশের জনগণ। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তিনি ৭ মার্চ কেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি? আসলে ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানীরা তা বুঝতে বা ধরতে পারেনি। তিনি বলেন, রাজনীতি করতে হলে ইতিহাস জানা খুব দরকার। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু কীভাবে ধাপে ধাপে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার জন্য এত আত্মত্যাগ, এত রক্ত আর কোন জাতি দেয়নিÑ যা বাঙালীকে দিতে হয়েছে। এত রক্তের দাগ বৃথা যেতে পারে না, আমরা বৃথা যেতে দেবও না। উন্নত-সমৃদ্ধ ও সুখী-সুন্দর দেশ গড়ে আমরা স্বাধীনতার মর্যাদা রাখব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলব। তিনি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলে এ উন্নত দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশবাসীর প্রতিও আহ্বান জানান। সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের আলোচনা সভা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের মতো ছোট পরিসরে না করে আগামীতে বড় প্রাঙ্গণে করার দাবি তুললে উপস্থিত নেতাকর্মীরা তুমুল করতালি দিয়ে এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। আমির হোসেন আমু বলেন, ষড়যন্ত্র আছে এবং থাকবে। ঐক্যবদ্ধ থেকে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের কথা বলেন, অথচ কাউন্সিল হলেও কমিটি নেই, কে তাদের মহাসচিব তাও কেউ জানে না। ক্ষমতায় গেলে উনি (খালেদা জিয়া) আর প্রতিহিংসার রাজনীতি করবেন না! দেশের কোন মানুষ তাঁর এ কথায় বিশ্বাস করে না। কারণ এদের রাজনীতিই হচ্ছে হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের, গণতন্ত্রে তারা বিশ্বাসী নয়। তোফায়েল আহমেদ দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, এবার স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তির পাশাপাশি ঐতিহাসিক ৬ দফারও ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করছেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। মনে হয় শেখ হাসিনার মাঝেই বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন। একমাত্র শেখ হাসিনাই পারবেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে। মতিয়া চৌধুরী বিএনপির কাউন্সিলের সমালোচনা করে বলেন, কাউন্সিলের জায়গা দেয়া হচ্ছে না বলে কত কান্নাকাটি করা হলো। জায়গা দেয়ার পর কাউন্সিলের নামে তারা কী করল? সম্মেলন হলেও কমিটি নেই। গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের হাতেই সব ক্ষমতা দেয়া হলো। আসলে দলের মহাসচিবকে ‘আবদুল’ বানাতেই কাউন্সিল করেছে বিএনপি। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, এ দেশের সবচেয়ে ক্ষতি যদি করে থাকে তিনি হলেন জেনারেল জিয়া। আর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা মুক্ত করার ভিশন দিচ্ছেন! তার এ ভিশনের উদ্দেশ্যই হলো শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। যা তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের মতো খালেদা জিয়ারও একদিন এ দেশের মাটিতে বিচার হবে। সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সত্তরের নির্বাচনে দেশের জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার অন্য কারোর ম্যান্ডেট ছিল না। তাই ভুয়া বা মিথ্যা কোন কিছু কখনই টেকে না, আগামীতেও টিকবে না।
×