ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

কিউবা, যুক্তরাষ্ট্র এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৮ মার্চ ২০১৬

কিউবা, যুক্তরাষ্ট্র এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানটি যখন হাভানার হোসেমার্তি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে, তখন রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি। বিমানের দরজা খুলে ছাতা মাথায় যখন ওবামা বেরিয়ে আসেন, ৮৮ বছর পর কিউবায় পা রাখা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে, তখন সারাবিশ্ব দৃশ্যটি অবলোকন করেছিল। দীর্ঘদিনের বৈরী কমিউনিস্ট দেশে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর বিস্ময় জাগিয়েছিল বৈকি! সম্পর্কের শীতলতা পেরিয়ে উষ্ণতায় ধাবিত হতে দুটো দেশ আজ সচেষ্ট। কিন্তু এই কিউবার জন্য মার্কিন প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বহু মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল। কিউবায় চটের বস্তা রফতানি করার খেসারত দিতে হয়েছিল বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে। ওবামা-রাউল বৈঠকের আড়ালে চুয়াত্তরের বাংলাদেশের দৃশ্যপট অনেকের মনেই ভেসে ওঠেছিল বৈকি! ইতিহাসের পাতায় চোখ মেলে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধ জাহাজে চড়ে ১৯২৮ সালে কিউবা সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ। হাভানায় তার ট্রেনে ও নৌবাহিনীর জাহাজে করে পৌঁছতে সময় লেগেছিল তিন দিন। আর ৮৮ বছর পর ওবামার পৌঁছতে সময় লেগেছে তিন ঘণ্টার কম। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে আঠারো শত কিলোমিটারের দ্বীপ দেশটি। কত কাছের হলেও আদতে বহু দূরের। সম্পর্কের দূরত্ব উত্তর-দক্ষিণ মেরু হতেও অধিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিউবায় তিন দিনের ঐতিহাসিক সফর করলেন বারাক ওবামা। বৈরী ও শত্রু দেশ হিসেবে চিহ্নিত কিউবায় এই সফরের মধ্যদিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক এক নতুন যুগে প্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধকালীন বৈরিতার জেরে দীর্ঘ সময় দেশটির সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক ছিল অস্থির, টানাপোড়েনে জর্জরিত। পর্দার অন্তরালে চলা প্রায় দেড় বছরের সমঝোতার ফল হিসেবে দু’দেশের মধ্যে গত বছরের আগস্টে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হয়। ওবামার এ সফর ওই সমঝোতার এক চূড়ান্ত রূপ বলা যায়। ১৯৫৯ সালে মার্কিনপন্থী ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে গদিচ্যুত করেছিলেন বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো। অভিযোগ ছিল যে, বাতিস্তাকে সামনে রেখেই কিউবার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাতিস্তার পতনের পর ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে নতুন ইতিহাস তৈরি হয় কিউবায়। আর যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা মুখ দেখাদেখি কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখনই। নয় হাজার শান্তিকামী গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে হাভানায় ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী অভিযানে সহযোদ্ধা ছিলেন চে গুয়েভারা। পালিয়ে যায় বাতিস্তা যুক্তরাষ্ট্রে। ক্যাস্ট্রো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বেসরকারী এক সফরে ওয়াশিংটনে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ফিদেল বৈঠক করেছিলেন। এ ঘটনার পর নিক্সন লিখেছিলেন, কিউবার বামপন্থী নেতাকে ‘ডান দিকে’ পরিচালিত করার চেষ্টা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোন উপায় ছিল না। ১৯৬০ সালে কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের সব ব্যবসা ও সম্পত্তি জাতীয়করণ করা হয়। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৬১ সালে ফিদেল কিউবাকে কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। বিশ্ব মানচিত্রে এখনও কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে কিউবা নিজের শক্ত অবস্থানকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বহু বাধা-বিপত্তির পরও। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ফিদেলকে হত্যার বহু চেষ্টা করে। খাদ্যে বিষ মিশিয়েও তা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় রাশিয়াকে কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের অনুমতি দেয় হাভানা। রুশ-মার্কিন পারমাণবিক যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তখন। ১৯৯৩ সালে এসে কিউবার অর্থনীতিকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে। প্রায় পাঁচ দশকের শাসন শেষে ফিদেল বার্ধক্যজনিত কারণে তার সহোদর রাউলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর রাউল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল অবস্থা থেকে উষ্ণ করার প্রচেষ্টা চালান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাও কিউবার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কিউবানদের পরিবারসহ কিউবা ভ্রমণ ও রেমিটেন্স পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন ওবামা। ২০১২ সালে এসে কিউবা ঘোষণা করে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। পরবর্তী দু’বছর সম্পর্ক পুনঃস্থাপন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করে এবং দূতাবাস চালু করে দু’দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ফোনালাপও চলে। সেতুবন্ধ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পোপ ফ্রান্সিসও। তিনিও কিউবা সফর করেন। গত বছরের আগস্টে ৫৪ বছর ধরে বন্ধ থাকা মার্কিন দূতাবাস চালু হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি শিক্ষা থেকে ভ্রমণ পর্যন্ত কিউবার ওপর জারি থাকা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন ওবামা। তবে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টি ঝুলে থাকে। দু’দেশের বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে বলা হয়, ‘অর্থনৈতিক বিনিয়োগই নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক বাহিনী হতে পারে। কারণ কিউবাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটি তো পরিষ্কার। কিউবাকে একটি বহুত্ববাদী ও সমৃদ্ধ সমাজে রূপান্তর ও বিশ্বের কাছে আরও মুক্ত করে দেয়াÑ যেখানে পণ্য, পরিষেবা, মূলধন ও আদর্শের প্রবাহটি হবে অবাধ’। কিউবার অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কমিউনিস্ট দেশ কিউবায় ওবামার সফরকে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দুই দেশ বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও তাদের মধ্যে এখনও এমন কয়েকটি বিষয় রয়ে গেছে, সম্পর্ক জোরদার করতে যেগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। সফরকালে ওবামা এমনটাও বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন, কিউবায় পরিবর্তন শুরু হয়েছে। মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে এই পরিবর্তন তিনি দেখতে পেয়েছেন। অভিযোগও করেছেন, কিউবায় এখনও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চলছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণও ভিন্ন মতের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, কিউবা একদলীয় সরকারের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসুক। কিন্তু রাউল মনে করেন, তাদের কাছে এটি হচ্ছে একটি দলের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র। এটা স্পষ্ট যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রাস্তায় অবশ্য অনেক খানাখন্দ বোজানো এখনও বাকি। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ফিদেলের আমল থেকে আমেরিকায় চাপানো আর্থিক নিষেধাজ্ঞা। ওবামা বহু আগেই এই নিষেধাজ্ঞা তোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের বাধায় এ নিয়ে এগোনো যায়নি। যদিও দুটি দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ক্রমশ প্রশমিত হচ্ছে। বিশ শতকের অন্যতম সেরা বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে ওবামা সাক্ষাত করেননি। উভয়পক্ষ এতে আগ্রহী ছিল, তা নয়। মার্কিন জনগণের একটা বড় অংশের মতোই কিউবায় তরুণ প্রজন্ম ও উভয় দেশের সম্পর্কোন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবার অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় এগারো শত বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে মার্কিন অর্থনীতিতেও প্রতিবছর ক্ষতি হয়েছে সোয়া বিলিয়ন ডলার। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দুটি দেশ নিশ্চয় আরও সচেষ্ট হবে। কমিউনিস্ট দেশ কিউবা তার নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণেই। প্রবল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়া দুটো সমাজÑ কিউবা ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল কিউবার নেতার সঙ্গে, ফিদেল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর সিদ্ধান্ত; অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল কিউবা। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র মুুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বৈরী দেশ। ১৯৭২ সালে কিউবা ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বাংলাদেশকে প্রথম দিকে স্বীকৃতিদাতা দেশগুলোর মধ্যে কিউবা ছিল অন্যতম। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর দুই বছর খরায় আউশ ও আমনের ফসলের চরম ক্ষতি হয়। ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় বন্যা। একদিকে যুদ্ধাকালীন ক্ষয়ক্ষতি। অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর সঙ্গে জড়িত হয় ফড়িয়া ও চোরাকারবারিদের সীমাহীন অর্থলিপ্সা। উপরন্তু চরমপন্থী, উগ্রপন্থী, স্বাধীনতায় পরাজিত শক্তি, দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র সহিংস কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ায় দেশে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে দুষ্প্রাপ্যতাও। সব মিলে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্ভিক্ষ-যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলা করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের ক্ষত শুকানোর আগেই প্রকৃতির রুদ্ররোষে কাবু তখন দেশ। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের প্রায় সর্বত্র প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলসমূহ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই দেশে খাদ্যাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রথম অনাবৃষ্টিতে এবং পরে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেশে এখাদ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ। এই বছর একই কারণে ভারতেও খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল। এই পরিস্থিতি পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইইসি সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশও অষ্ট্রেলিয়া থেকে পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানি করার জন্যে। কিন্তু চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি এবং দুষ্কৃতকারীদের খাদ্য গুদামে অগ্নিসংযোগ ও খাদ্য বহনকারী ট্রাক, ট্রেন ও জাহাজ ধ্বংস করার মতো অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ দেশে সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস দুটোতে বাংলাদেশের জনজীবনে এক নজিরবিহীন খাদ্য-বস্ত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্যজনিত বিপর্যয়ের আশাপাশি নেমে আসা আর এক অভিশাপ- সর্বনাশা বন্যা। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ঢাকার বিভিন্ন বিদেশী মিশন ও দূতাবাস বন্যার ধ্বংসলীলার সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ করে। বন্যায় ফসল মার খেল প্রায় ১০ লাখ টন। বিশ্বজুড়ে তখন মন্দাভাব। খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোয় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সারাবিশ্বে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে বিশ্ববাজারে সব পণ্যের দামই তখন চড়া। বেশি দামে খাদ্য কিনে সঙ্কট মোকাবেলার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না সরকারী কোষাগারে। রফতানি আয়ের একমাত্র উৎস তখন পাট। তাতেও মন্দাভাব। সত্তর দশকে বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এটাও বলেছিল বঞ্চিত-বুভুক্ষু বিশ্বের এক শ’ কোটি মানুষ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বোঝা। জাতিসংঘ অবশ্য সুপারিশ করেছিল, ধনী দেশগুলো তাদের জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) শতকরা শূন্য দশমিক সাতভাগ বঞ্চিত- বুভুক্ষু দেশগুলোতে নিয়োগ করুন। এর আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ঘোষণা করেছিলেন, তার সরকার যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ কাজে পুরো শক্তি নিয়োগ করেছে। বঞ্চিত বুভুক্ষু মানুষের দেশে অর্থ সাহায্য বাড়াতে পারবে না। জাতিসংঘের প্রস্তাবটি প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই সে সময়ের বিশ্বের দ্বিতীয় ঐশ্বর্যশালী অঞ্চল ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ইইসি) জোট তাদের জিএনপি’র শতকরা শূন্য দশমিক এক ভাগ ও নিয়োগ করতে রাজি হয়নি। তবু বাংলাদেশ সে বছর ৭৩২ কোটি টাকার খাদ্য শস্য আমদানি করেছিল। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্য সাহায্যের জন্য আবেদনও করে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে আসে অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন জানতে পারে, বাংলাদেশ কিউবার কাছে চটের ব্যাগ বিক্রি করছে। মার্কিন খাদ্য সাহায্য আইন পিএল ৪৮০ অনুসারে যে দেশ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করছে, সে দেশ খাদ্য সাহায্যের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন নয়। বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন মাত্র একবারের জন্য ৫০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ৪০ লাখ চটের ব্যাগ বিক্রি করে কিউবার কাছে। কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী কোন বাণিজ্যিক চুক্তি হয়নি। নিয়মিত কোন ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু মার্কিন আইনের এমন বিধান সম্পর্কে বাংলাদেশ অবহিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে, বাংলাদেশ যদি এ মর্মে ঘোষণা দেয়, ভবিষ্যতে কিউবার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ করে দেবে, তাহলে খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দাবিটি মেনে নেয়। এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের চরম দিন ক্রমশ মৃত্যুমুখী করে তুলেছিল মানুষকে। যদিও বঙ্গবন্ধুর সরকার খাদ্য ঘাটতি পূরণে ৭৪ সালের শুরুতেই অষ্ট্রেলিয়া, ইইসি সদস্যভুক্ত দেশ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করেছিল। চলতি বাজার দরেই এসব খাদ্য ও পণ্য কেনার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ না করায়, এমনকি নগদ টাকার বিনিময়েও খাদ্য জাহাজ পৌঁছে না দেয়ার ফলেই দুর্ভিক্ষ তীব্রতর হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছানোর জন্য স্থিরকৃত দুটো বড় চালানের বিক্রয় বাতিল করে। বাংলাদেশ বহু চেষ্টা করেও মার্কিন সরকারের সহায়তা লাভে ব্যর্থ হয়। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে সেদিন যারা মারা গিয়েছিল, তাদের প্রতি সামান্য অনুকম্পা দেখায়নি যুক্তরাষ্ট্র। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ তারা নিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের গণহত্যার পর আরও মানুষ হত্যা করার বন্দোবস্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র সেদিন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে মরতে হতো না। ইতিহাসের চাকা ঘুরতে ঘুরতে একদিন প্রমাণিত হবেই যে এই সব মানুষের মৃত্যুর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কালো হাত সক্রিয় ছিল। আজ কিউবা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গড়তে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের জীবনে দুর্ভিক্ষের ছাপ মুছে যাবে না।
×