ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩৬ মাইল দীর্ঘ পদযাত্রা

শোকের শহীদ মিনার থেকে শক্তির স্মৃতিসৌধ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৭ মার্চ ২০১৬

শোকের শহীদ মিনার থেকে শক্তির স্মৃতিসৌধ

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ পথ। ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু। সেই পথ ধরে বহুকাল হেঁটে স্বাধীনতার সংগ্রাম। বিজয় দিবসে শনিবার ইতিহাসটি নানাভাবে স্মরণ করা হলো। ছিল অজস্র কর্মসূচী। তবে বিশেষভাবে বলতে হয় পদযাত্রা কর্মসূচীটির কথা। ভোর বেলায় ভাষা আন্দোলনের তীর্থভূমি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এ যাত্রার শুরু। শেষ হয় স্বাধীনতার গৌরব বুকে দাঁড়িয়ে থাকা জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে। এভাবে দীর্ঘ ৩৬ মাইলের পায়ে হাঁটা পথ! হাঁটতে হাঁটতেই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি খুঁজে ফেরা। অভিনব আয়োজনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নির্মাণে তহবিল সংগ্রহের কাজও করে অভিযাত্রী দল। পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী, ভোর বেলায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমবেত হয় অভিযাত্রী দল। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তরুণরা তো ছিলই। মাঝবয়সী এবং প্রবীণরাও দিব্যি যোগ দেন। নারীদের অংশগ্রহণ আরও বেশি অবাক করার মতো। কর্মসূচী শুরুর আগে শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় অভিযাত্রী দল। সবাই মিলে গানÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালাবাসি...। দেশের প্রতি এই যে ভালবাসা, শুধু তো ভালবাসা নয়, শক্তি। এ শক্তিই রাজধানী শহর থেকে সাভার পর্যন্ত হেঁটে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। নিজের ছোট্ট বক্তৃতায় উৎসাহ যোগান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এবং ইনাম আল হকও। শহীদ মিনার থেকে প্রথমে সবাই যান জগন্নাথ হলে। এখানে ২৫ মার্চ কালো রাতে নির্বিচার হত্যার শিকার মানুষদের কথা স্মরণ করা হয়। পুষ্পার্ঘ অর্পণ করা হয় বধ্যভূমিতে। পরে ফুলার রোড হয়ে ধানম-ি ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়া। জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফের মিরপুর রোড। কিছু সময় হাঁটার পর আসাদ গেট। ’৬৯ এর শহীদ স্মরণে এখানে কিছু সময় অবস্থান। এখান থেকে যুক্ত হন আরও কয়েকজন। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ওঠে আসে আসাদ গেটের ইতিহাস। আসাদের সঙ্গে মিছিলে অংশ নেয়া দু’জন হঠাৎ উপস্থিত হয়ে সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দেন। তাঁরাও শোনান আসাদের কথা। শ্যামলীতে পৌঁছে সবাই যান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত বাসভবনে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফের শুরু হয় পদযাত্রা। ততক্ষণে মাথার উপর সূর্য। প্রখর রোদে গা বার বার ভিজে ওঠছে। ফের শুকোচ্ছে। এ অবস্থায়ও হাঁটা থেমে থাকে না। কিছু সময় হাঁটার পর এসওএস শিশু পল্লী। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধ শিশুদের আশ্রয় দেয় এই প্রতিষ্ঠান। এখানে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি। তারপর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের দিকে হেঁটে চলা। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। এখান থেকেও পদযাত্রায় যোগ দেয় একটি দল। শুধু যে মূল রাস্তা ধরে হাঁটাÑ তা নয়। বরং মিরপুরের পর অভিযাত্রী দল মূল রাস্তা পরিহার করে কাঁচা পথে হেঁটে চলে। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতর দিয়ে হেঁটে তুরাগ নদীর পাড়ে পৌঁছেন তাঁরা। নৌকা করে নদী পার হতেই সবুজ ধানের ক্ষেত। পুরোটা রাস্তা আলপথ। তবুও হেঁটে চলা। কারণ ব্যাখ্যা করে কর্মসূচীর আয়োজকদের পক্ষে জাকারিয়া বেগ জনকণ্ঠকে বলেন, একাত্তরে প্রাণ বাঁচাতে মানুষ দিগি¦দিক ছুটেছেন। দুর্গম পথ ধরে হেঁটেছেন। কাঁচা রাস্তা, জমির সরু আল, বন জঙ্গল সব পাড়ি দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আমাদের জানা। হাঁটার মধ্য দিয়ে কিছুটা অনুভবের চেষ্টা করা। অভিযাত্রী দলে ছিলেন সারা যাকের। মঞ্চ ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে। বয়স তাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তিনিও দিব্যি জমির আল দিয়ে হেঁটে চলেন। কাঁদায় পা আটকে যায়, তবু মূল রাস্তা খুঁজতে নারাজ! কেউ কেউ পায়ে আঘাত পেয়েছেন। তাঁদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারাও বাড়ি ফিরতে নারাজ। স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত যাবেনই। পরে তিনজন গাড়িতে করে স্মৃতিসৌধে পৌঁছে মূল দলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। জানা যায়, পথিমধ্যেই দুপুরের খাবার সারেন অভিযাত্রীরা। ফের হাঁটা। বিভিন্ন পয়েন্টে তাঁদের স্বাগত জানাতে আসেন সাধারণ মানুষ। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সবাই যখন সাভারে পৌঁছেন, পায়ে ফুসকা! সমস্ত শরীর অবসন্ন। এর পরও চোখে মুখে হাসি। আহা, সে কী আনন্দ! সবাই স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এর পর গাড়িতে করে ফিরে আসা। মাঝখানে যেটুকু খরচ, তা-ও নিজেদের। আয়োজকরা জানান, ১৯৭১ সালে বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা আয়োজন করেছিলেন যারা, তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই এমন কর্মসূচী। ৩৬ মিটার হাঁটার সামর্থ্য সবার নেই। মূল অংশটি পুরোটা পথ হেঁটেছেন। বাকিরা হেঁটেছেন এক মাইল। জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে ন্যূনতম ১ হাজার টাকা প্রদান করে নিবন্ধন করেন তারা। তার পর হেঁটে চলা। শোকের শহীদ মিনার থেকে শক্তির উৎস স্মৃতিসৌধ। সব মিলিয়ে অনবদ্য বিজয় দিবস উদ্যাপন। এমন উদ্যোগের সত্যি কোন তুলনা হয় না।
×