ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভের টাকা লোপাটের সঙ্গে ১৪ বিদেশী জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৭ মার্চ ২০১৬

রিজার্ভের টাকা লোপাটের সঙ্গে ১৪ বিদেশী জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা লোপাটের সঙ্গে ৬ নয়, ১৪ বিদেশী জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। এর মধ্যে ফিলিপিন্সেরই ৮। অপর ৬ শ্রীলঙ্কার। সন্দেহভাজন এই ১৪ জনের বিষয়ে জানতে সিআইডি পুলিশ ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে। তাদের বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিন্সের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে অভিযানও চলছে। সেই সঙ্গে চার দেশ টাকা লোপাটের বিষয়টি তদন্তও করছে। এ চারটি দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের টাকা লোপাটের বিষয়ে গোপন তদন্তে নেমেছে। যেসব দেশ গোপন তদন্ত চালাচ্ছে, তাদের অনেক অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। ওইসব দেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্সের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। এছাড়া সুইফটের তরফ থেকে করা তদন্তের একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের অনুলিপি সিআইডির কাছে হস্তান্তরের কথা রয়েছে। সুইফটের তদন্তে কি বেরিয়ে এসেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে আজ থেকে টাকা লোপাটের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংগৃহিত আলামতের চূড়ান্ত পর্যালোচনা শুরু করছে সিআইডি। পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সুইফটের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহভাজনদের ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জমা রাখা টাকার মধ্যে ৮শ’ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় গত ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলাটি দায়ের করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়েরকৃত মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সিস্টেমের আওতায় সাড়ে ৪ হাজার কম্পিউটার রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটারের মধ্যে গুরুত্ব বিবেচনা করে ৫০টির ডাটা ক্লোন করে নেয়া হয়। এসব ডাটার পরিমাণ কয়েক হাজার। এ ছাড়াও ব্যাংকটির শতাধিক সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টাকা লোপাটের অন্যতম কারণ মনিটরিংয়ের দুর্বলতা। সার্ভার স্টেশনটি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের কথা থাকলেও তা হয়নি। এমন সুযোগে হ্যাকাররা যান্ত্রিক পদ্ধতির আওতায় থাকা টাকার মধ্যে ৮শ’ কোটি ছাড় করিয়ে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও হংকং তোলপাড় হয়। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছে। সিআইডির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাটের বিষয়টি বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে তদন্ত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তদন্তের সঙ্গে যুক্ত করেছে সেদেশটির অভিজ্ঞ তদন্তকারীদের। অর্থ লোপাটের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মার্কিন সরকার টাকা উদ্ধারে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ফেডারেল ব্যাংকের নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। হ্যাকারদের সব কিছু জানতে হন্যে হয়ে মাঠে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ব্যাংকের সুনাম অক্ষুণœ রাখতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে মাকির্ন সরকার। বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মার্কিন সরকারের তরফ থেকে। সিআইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ৮শ’ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় বিশ্বের অনেক দেশই গোপনে তদন্ত করছে। তবে তারা বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, যার যার দেশের স্বার্থে। ইতোমধ্যেই বহু দেশ বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিন্সের তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গেও ওইসব দেশের তদন্তকারীরা নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অনেক দেশ স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে টাকা রাখে, তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে সাইবার নিরাপত্তা, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানা বিষয় নিয়ে গোপনে অনুসন্ধান করে যাচ্ছে। অনেক দেশই খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে টাকা লোপাটের ঘটনায় রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওইসব দেশ খুবই উদ্বিগ্ন। কারণ ওইসব দেশের অনেক অর্থ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। বহু দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখে। এমন ঘটনায় ওইসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা রীতিমতো আতঙ্কিত। অনেক দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা যার যার দেশকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে ভবিষ্যতে কম পরিমাণে অর্থ গচ্ছিত রাখার পরামর্শও দিয়েছে। এসব দেশের পরিমাণ অনেক। বাংলাদেশের টাকা উদ্ধার না হলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যাংকটিতে অন্যান্য দেশের তরফ থেকে অর্থ গচ্ছিত রাখার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে বলেও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ধারণা। অন্যান্য দেশের তদন্তকারী সংস্থার বরাত দিয়ে সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের টাকা লোপাটের পরিকল্পনা প্রায় বছরখানেক আগে হয়। পরিকল্পিতভাবে টাকা লোপাটের ঘটনাটি ঘটায় হ্যাকাররা। সিআইডির তদন্তে টাকা লোপাটের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা, ব্যাংকের উর্ধতন কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। অন্যান্য দেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তারাও এমন মতামত দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তদন্তে অর্থ লোপাটের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ১৪ জন বিদেশী জড়িত বলে তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যাদের মধ্যে ৮ জনই ফিলিপিন্সের। দোষী বিদেশীদের আটক করতে ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে অভিযান চলছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বিদেশীদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও’র ৬ পরিচালক রয়েছেন। তাদের দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন সেদেশটির আদালত। শ্রীলঙ্কার তরফ থেকে বিষয়টির তদন্ত করছে সেদেশটির এন্টি মানিলন্ডারিং টিমসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তকারীদের ধারণা, লোপাট হওয়া টাকার কিছু অংশ ছ’জনের কাছে গেছে। শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রেশন বিভাগে ৬ জনের ছবিসহ বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। যাতে তারা দেশ ত্যাগ করতে না পারে। ওই ফাউন্ডেশনটি গত ২৮ জুন কলম্বোর একটি বেসরকারী ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খোলে। এর মাত্র ৬ দিন পরই প্রায় ২ কোটি মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে ওই এ্যাকাউন্টটিতে জমা হয়। ওই ঘটনায় শ্রীলঙ্কার ওই ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক করে এবং অর্থ ফেরত পাঠায়। সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮শ’ কোটি টাকা লোপাটের মূল হোতা চীনা বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী কিম অং বলে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ধারণা। লোপাট হওয়া টাকা ৫টি মেসেজের মাধ্যমে ফিলিপিন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) স্থানান্তরিত হয়। এরপর সোলাইরি রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস ম্যানিলা ও মাইডাস হোটেল এ্যান্ড ক্যাসিনোর মাধ্যমে হংকং চলে যায়। ফিলিপিন্সের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) টাকার চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভারজারা, এনরিকো তিয়োডোরো ভাসকুয়েজ ও উইলিয়াম সো গো ও চীনা বংশোদ্ভূূত ব্যবসায়ী কাম সিন অং (কিম অং)-কে শনাক্ত করে। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে ব্যাংকটির জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতো নিজের দোষও স্বীকার করেছেন।
×