ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির

উদ্যত সঙ্গিনের নিচে

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৬ মার্চ ২০১৬

উদ্যত সঙ্গিনের নিচে

আমরা ১০ জন। একাত্তরে হানাদার পাকি বাহিনীর ডেথক্যাম্পে নির্যাতিত আমার ৯ সাথীকে স্মরণ করি সব সময়ে। ওই ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেনি চারজন, ফিরে আসা একজনও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি আমার বাবা। একাত্তরে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা আমার সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাবা ও ছোট বোন বকুলের স্বামী হীরাকে। বাবা মারা গেছেন ২০০৪ সালে। হীরা’র হাঁটুর ব্যথা এখনও জেগে ওঠে কখনও। আমার নানা আদিব্যাধিতে ভোগার উৎসে রয়েছে সেই তখন থেকে বয়ে বেড়ানো নির্যাতনে ক্ষতাক্ত দেহ। এখনও কবে কখন অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তা জানতে পারি শরীরের ব্যথা-যন্ত্রণা থেকেই। এ নিয়ে ১৯৮৩ কি ’৮৪ সালে দৈনিক সংবাদে এক উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। সঙ্গিন উঁচিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা খেতে বসেছিলাম, আমাদের পরনে ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। আল বদর সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটাতে শুরু করে আমাকে। পর দিন কমান্ডার কয়েক বার সাইকেলের চেন দিয়ে মেরে, বেসিনের নিচের বাঁকা পাইপ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে আমাকে, মিলিশিয়ারা দুই হাত প্রায় ঝাঁঝরা করে দেয় আলপিন ফুটিয়ে, বারবার দেয় জ্বলন্ত কে-টু সিগারেটের ছ্যাঁক। চুলের মুঠি ধরে কয়েকবার দেয়ালে ঠুকে দেয় মাথা। তারপর সংজ্ঞা হারাই। এভাবে থাকি অচৈতন্যের মধ্যে ডুবে। নির্যাতনের ফলে পরনের গেঞ্জিটা আমার পিঠ ও আশপাশের চামড়ায় সেঁধিয়ে গিয়েছিল প্রায়। প্রাণটুকু নিয়ে কোনও রকমে ফিরে এসে দেখি আমার রিক্ত নিঃস্ব গরিব বাড়িটা (এখনও তা-ই আছে) নিষিদ্ধ হয়ে আছে পাড়ায়, শহরে। ভয়ে কেউ আসে না উঁকি দিতে। তারপরও রাত ১০টার দিকে আমার ফিরে আসার খবরে এক-দুই করে আসেন পাড়ার অনেকে। কিন্তু একজন ডাক্তার দরকার, কিন্তু কে আসবেন? পাকি বাহিনীর চরম রোষের শিকার একজনের ধারেকাছে যাওয়াও তো বিপজ্জনক! শেষে এলেন ডা. আবুবকর সিদ্দিকী। তিনি একটি ট্রিট ব্লেড চেয়ে নিয়ে চামড়া কেটে-কেটে বের করেন গেঞ্জিটা। পরে এটিএস ইনজেকশন দিলেন, আর একটা জামবাক দিয়ে বলেন নিয়মিত মালিশ করে তারপর কাপড়ের ছ্যাঁক দিতে। এই একমাত্র চিকিৎসাই চলেছে তখন। প্রচ- আক্রোশ নিয়ে যে নৃশংস নির্যাতন করা হয় তাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল বিশেষ করে আমার পিঠ, ঘাড়, হাত ও মাথা। এ কারণে শয্যাগত থাকতে হয় মাসখানেক। মাথায় ক্ষতের কারণে বাধ্য হই ন্যাড়া হতে। রাত ন’টায় বাড়ি ঘেরাও করে আমাদের তিনজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন পাঞ্জাবি মিলিশিয়া আর আল বদর বাহিনীর এক দল সদস্য। এই সদস্যদের দু’জন আমার পরিচিত। তাদের একজন স্বাধীনতার পর কয়েক বছর বন্দি জীবন কাটিয়ে মুক্তি পেয়েছিল বটে, তবে বাঁচেনি বেশি দিন। জেনেছিলাম দেখামাত্র সঙ্গিন দিয়ে কতল করার মতলব নিয়ে এসেছিল ঘাতকেরা, কিন্তু কিভাবে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে কেবল বুকের ধুকপুকুনি নিয়ে ফিরে এলাম তা কে জানে! এ নিয়ে অনেক আলোচনা শুনেছি, অনেক কথা শুনেছি। কুমুদিনী কলেজের অধ্যক্ষা, বাল্যবন্ধু ফারুক কোরেশীর মা, নাজমা হামিদ অনুরোধ করেছিলেন পাকি অধিনায়ককে। বলেছিলেন, আমার ছেলের বন্ধু। ছোটবেলা থেকে চিনি। স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটিতে ক্লাশের ফার্স্ট বয়। ও বই পড়া ছাড়া আর কোনও কাজ পারে না। কাকতালীয় কিছু ঘটনার কথাও শুনেছি, জেনেছি। যে রাতে গ্রেফতার হই আমরা ওই রাতেই টাঙ্গাইল কমান্ড বদলি হয়ে যায় কামালপুর, ওই সময় সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করা হয় ‘বিপথগামী দুষ্কৃতকারীদের’ জন্য। দেড়-দু’দিন পর ঢাকা থেকে আসে নতুন দলবল। এই দলের সুবেদার মেজর খানান খান দাবি করে, সে জাতিতে পাঠান। মওলানা ভাসানীর নাম সে জানে। তার চেনাজানা অনেকে তাঁর মুরিদ। সে মুরিদ না হলেও ওই ভাবাপন্ন। আমার সহবন্দি বাল্যবন্ধু গোলাম আম্বিয়া নূরী বরাবরই বাকপটু। ওর বাকপটুত্ব বেশ কাজে লেগেছিল তখন। ও বোঝাতে পেরেছিল, আমরা আসলে মওলানা ভাসানীর অনুসারী। খানান খান জানায়, সাধারণ ক্ষমার আদেশ-নির্দেশ যাতে মেনে চলা হয় তা সে দেখবে। বাবাকে একদিন পর ছেড়ে দেয়ার পেছনে সম্ভবত বিশেষ ভূমিকা ছিল তার। কিন্তু পাঞ্জাবি নিরাপত্তা কর্মকর্তা হাকাম চলতো ফিরতো পৈশাচিক হিংস্রতা নিয়ে, তার ভাবভঙ্গিতে ছিল ঘাতকের উল্লাস। আমাদের ১০ জনকে এখনই কেন খতম করা হচ্ছে না- তা নিয়ে সে ছিল চরম ক্ষুব্ধ। তবে মুক্তি পাওয়ার একদিন পরেই শহরের নিরালা মোড়ে তার দুই হাত চেপে ধরেন বাবা। বলেন, ‘আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও!’ হাকাম বলে, ‘ঠিক আছে, তবে আমি দেখবো সে কি করে!’ পরে শহরের কোথাও দেখা হলে লোকজনের সামনে বিশ্রীভাবে আমাকে হেনস্তা করতো সে। শুনেছি টাঙ্গাইল থেকে বদলি হয়ে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার কিছু দিন পর বোমা হামলায় নিহত হয়েছিল ওই রক্তপিপাসু ঘাতক। আমার পিতামহ ছিলেন দেলদুয়ারের পীরসাহেব, এককালের জনপ্রিয় শিক্ষক। তাঁর মুরিদেরা এসেছিলেন বাবার খবর পেয়ে। তাঁরা মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও শান্তি কমিটির নেতাদের কাছে গিয়ে বলেন, পীর সাহেবেরে নাতির গায়ে হাত দিয়েছো? আগুনে হাত দিয়েছো! তোমাদের পাকিস্তান টিকবে না! এম এ পাস ছেলে, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষিত জন - এদের মেরে ফেলে কি পাকিস্তান চাও? সে পাকিস্তানের থাকবে কি? অমন পাকিস্তান আমরা চাই না। তবে আল বদর সদস্যদের ক’জন ফোঁস-ফোঁস করে সঙ্গিন হাতে নিয়ে। চোখের সামনে ঘোরায়, চেপে ধরে বুকে। ক’জন আবার থামিয়ে রাখে তাদের। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে, বাড়ি শেরপুর-জামালপুরে। তাদের একজন ১৯৭২ সালে টাঙ্গাইলে এসে দেখা করেছিল আমার মতোই নির্যাতিত এক মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার বখশের সঙ্গে। বলেছিল- আনোয়ার, আমার ও অন্যদের প্রাণরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা ছিল তার। ওই আল বদর সদস্যদের মতে, আমার অপরাধ- আমি মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিস্ট ও নাস্তিক। আমি ঢাকায় শহীদ মিনারে স্বাধীনতার কবিতা পড়েছি, ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে পাকুল্লা-নাটিয়াপাড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত করেছি, বাল্যবন্ধু কাদের সিদ্দিকী ও বুলবুল খান মাহবুবের সঙ্গে যোগসাজশ করে শহরে গ্রেনেড-বোমা হামলা ঘটাচ্ছি এবং আরও অনেক কিছু। তারা নানাভাবে পরীক্ষা করে আমাকে, জিজ্ঞেস করে কবি ইকবাল ও ফররুখ আহমদ সম্পর্কে। কে বড়- রবীন্দ্রনাথ না নজরুল? আমার উত্তর শুনে শহীদ নামে তাদের এক কমান্ডার বলে, এর সঙ্গে কথা কইয়া পারবা না। এইটা জ্ঞানপাপী। এই শহীদের পরিচয় পেয়েছি পরে। ক্যাম্পে আমার গায়ে হাত তুলেছিল সে-ই। ১৯৮২ সালে টাঙ্গাইল থানার এক কর্মকর্তা নবাব আলী (সাংবাদিক শওকত মাহমুদের ভগ্নিপতি) করটিয়া-ইসলামপুরে এক অভিযানে গিয়ে ধরেছিলেন তাকে। তারপর থার্ড ডিগরি’র চরম ব্যবহার করে আমাকে এসে জানিয়েছিলেন, আপনার গায়ে হাত তোলার মজা ওর হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছি!একাত্তরে হানাদার পাকি বাহিনীর ডেথ ক্যাম্পে আমার ১০ সাথীর একজন ছিল বাল্যবন্ধু গোলাম আম্বিয়া নূরী। ও এখন দেশখ্যাত নাট্যকার। টাঙ্গাইলে থাকে। কয়েক বছর আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের সে অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখলি না?’ বললো, ‘তুই লিখবি।’ আমি বিচ্ছিন্নভাবে লিখেছি। বলেছি বিভিন্ন ফোরামে। বিটিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম বিজয়ের পর-পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। এর কয়েক মাস পর নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসার জন্য সরকার দিয়েছিল ৩৫০ টাকা। আম্বিয়া সম্প্রতি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে ডেথ ক্যাম্পে আমার ওপর যে নৃশংস নির্যাতন চলার কথা উল্লেখ করেছে। আম্বিয়া আমার আত্মীয়, ছোটবেলায় খেলার সাথী। ডেথ ক্যাম্পে আরও তিন জন ছিল আমার খেলাধুলার সাথী - ছানা, খোকন ও অরুণ। আর ছিলেন অরুণের পিতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক হেরম্বনাথ রায় (কান্তি বাবু)। তাঁর লেখা স্বাস্থ্য বিষয়ক বইটি আমাদের পাঠ্য ছিল সপ্তম শ্রেণীতে। ছাড়া পেয়ে আসার সময় আমাকে তিনি বলেছিলেন সন্তোষ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঈন বি.টি.’র দেখা করতে। তিনি তদবির করলে হয়তো ছাড়া পাবেন তাঁরা। একই সঙ্গে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু। আমাদের ছাড়বে না।’ ছাড়া পাওয়ার একদিন পরেই দেখা করি মঈন বি.টি.’র সঙ্গে। সব শুনে চুপ করে থাকেন তিনি, কিছু বলেন না। সম্ভবত এরই মধ্যে তদবির করে ব্যর্থ হয়েছেন, অথবা জেনেছেন কান্তি বাবু, অরুণ ওরা আর নেই। স্বাধীনতার পর খোকনের বউ একদিন বাসায় আসে দেখা করতে। তার কোলে এক শিশুপুত্র। বলে, ‘খোকনের হত্যাকারী আল বদর কমান্ডার মনির মওলানার বিরুদ্ধে মামলায় আপনাকে সাক্ষী করা হয়েছে।’ আদালত থেকে সমন এলে আমি যাই সাক্ষ্য দিতে। বসে থাকি, কাউকে দেখি না। পিপি তারা উকিল বলেন, আবার তারিখ পড়বে। এর মধ্যে পাড়ার ছানু, ছোটবেলায় আমার খেলার সাথী, দেখা করতে আসে বাসায়। বলে, ‘মনির মওলানা আমার ভায়রা। সে নির্দোষ। কাউকে হত্যা করেনি।’ আমাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মনির মওলানা শনাক্ত করেছিল হীরাকে। একই এলাকার লোক তারা। আগে থেকেই চেনা-জানা। তাহলেও তার সঙ্গে যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছে সে। আমাকে ‘বেয়াই’ বলে সম্বোধন করলেও জঘন্য ভাষায় বকাঝকা করেছে অনেক। আদালতের সমন পেয়ে আরও দু’বার গিয়েছি, কিন্তু দেখা পাইনি বাদী ও বিবাদী পক্ষের কাউকে। উকিল বলেন, এই তো অবস্থা! কি আর করবে? আর এসো না। কয়েক বছর আগে হীরা জানিয়েছে, ঘরে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছে মনির মওলানা। ডেথক্যাম্পে আর এক সাথী ছিল আখতার বোখারি। সে ছিল তখনকার এক সাংস্কৃতিক কর্মী। পরে তাকে দেখেছি ফকিরি লেবাসে। এখন বড় রাজনৈতিক নেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী উলেমা লীগের সভাপতি। আর এক সাথী মজিবর, লেপ-তোশক দোকানের কর্মী। ১৯৭৭-৭৮ সালে শেষ দেখেছি তাকে। তখনও ছিল তার নাকের ক্ষতটা। একাত্তরে হানাদার পাকি বাহিনীর ডেথ ক্যাম্পে আমার মতো আরও অনেকেই ছিল প্রায় একই সময়ে। তাদের মধ্যে ন্যাপ নেতা নূরুন্নবী মাস্টার, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এস এম রেজা, নাট্যাভিনেতা আবদুর রহমান রক্কু, ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আলীমুজ্জামান খান রাজু আজ নেই। এখনও বেঁচে আছে আনোয়ার বখশ, খন্দকার নাজিমউদ্দিন, খন্দকার বাবুল চৌধুরী। আনোয়ার বখশ স্কুল জীবন থেকে সহপাঠী ছিল আমার। এখন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা। ওর বোন খালেদা বেগম টুনটুনিও আমার সহপাঠী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওদের ভাগনি নিলুফার পান্না (মিসেস ফেরদৌস কোরেশী) ইংরেজি বিভাগে পড়ত, তবে আমাদের ব্যাচেরই ছাত্রী। এদের মধ্যে খন্দকার নাজিমউদ্দিন সম্প্রতি পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমার ওপর পাকি সেনাদের নৃশংস নির্যাতনের বিষয়টি উল্লেখ করেছে বিশেষভাবে। ডেথক্যাম্প থেকে ফেরার সপ্তাহ দুই পর পাড়ায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয় কয়েকটি। আবার শুরু হয় ধরপাকড়। সিরাজ কমান্ডারের নেতৃত্বে রাজাকারের দল আসে পাড়ায়। বলে, ভাতিজা শুধরায় নাই। ছাইড়া দিয়া ভুল হইছে। পাড়ার মুরুব্বিরা তাদের বোঝায়। বলে, বাবর (আমার ডাকনাম) তো এখনও বিছানায়। নড়তে চড়তে পারে না। সিরাজ কমান্ডার বলে, সব পাড়ার মানুষ রাইত জাইগা পাহারা দিতাছে- যাতে গ্রেনেড-বোমা না ফুটে। আপনেরা কি করতাছেন? মুরুব্বিরা বুঝতে পারেন পাড়ার ছেলেদের বাঁচাতে চাইলে আর কোনও পথ নেই। খাজা কাকা, কামরুদ্দিন কাকা, নায়েব সাহেবসহ অনেকে ডাক দেন কিশোর-তরুণদের। এগিয়ে আসে চুন্নু ও দেলখোশ ভাই, হাবিবুল্লাহ খান (সাবেক প্রধান শিক্ষক, গভর্নমেন্ট লেবরেটরি স্কুল), রেজাউল হাসান বাবুল (নাট্যকার মামুনুর রশীদের ছোট ভাই), মনজুরুল হক আলমগীর, আনোয়ার ইকবাল, আকবর কবির, ফরহাদ, মঈন, সুশীল, বাবুল, শিবু, দিপু, প্রদীপ, জালাল, হাতেম, কাশেম, শাহজাহান, তোতা, ধলা শাহজাহান, দারু, রুবেল ও তাদের বন্ধুরা। (এদের অনেককে নিয়েই ১৯৭৬ সালে গড়েছিলাম ‘চম্পক নাট্যগোষ্ঠী’, ‘টাঙ্গাইল নাট্যোৎসব’-এ যোগ দিয়ে পেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালকের পুরস্কার; আজ অনেকে নেই।) এরপর উদ্যত সঙ্গিনের নিচে শুরু হয় আমাদের ভরসাহীন জীবন। তবুও পাড়ার হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলে চেষ্টা করি প্রাণপণে প্রাণ বাঁচাবার। এরপর থেকে আমাকে যে অনেকে এড়িয়ে চলত তা বন্ধ হয় ধীরে-ধীরে। অবশ্য আমার ছাড়া পাওয়ার খবর পেয়ে করটিয়ার নামদার কুমুল্লি থেকে জওশন ভাই (সা’দত কলেজের অধ্যাপক জওশন খান) এসেছিলেন ছুটে। ক’দিন পর করটিয়া থেকে এসেছিল মু. মঈনউদ্দিন আহমেদ (বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী, পিছিয়ে পড়ায় সা’দত কলেজের ছাত্র, পরে নাট্যকার সেলিম আল দীন নামে খ্যাত)। দিঘুলিয়া থেকে এসেছিল ছড়াকার-বন্ধু মওদুদ খান মজনু। তবে শহরের অনেক বন্ধুই আসে নি তখন। ভয় পেত তারা- আমার সঙ্গে মিশলে, কথা বললে যদি বিপদে পড়ে! আমাকে সঙ্গিন দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে আসা ঘাতকের দল আমার ডাকনাম ধরেই খুঁজেছিল সেদিন। কিন্তু কারা আমার নাম-ঠিকানা দিয়েছিল তাদের, নিশ্চিত করতে চেয়েছিল আমার মৃত্যু? নাম শুনেছি আমার চেনা-জানা কয়েকজনের। নৃশংসভাবে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষোভ যায়নি তাদের, যায়নি এই এখনও। অথচ ১১ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত হওয়ার পর রাতারাতি ভোল পালটে ফেলে তারা। সেদিন ডেথক্যাম্প থেকে আমার বেঁচে আসাটা যেন অন্যায় হয়েছিল, তাই তারা রটিয়ে বেড়িয়েছে- আমি নাকি মুচলেকা দিয়ে এসেছি হাকামের কাছে। না, মুচলেকা নয়, হাকামের হুমকিই ছিল যথেষ্ট। সে বলেছিল, পালিয়ে যাবে? যেতে পারো? কিন্তু তোমার মা তো যেতে পারবে না? তোমার ছোট দু’টি ভাই, সাতটি বোন- তারা যাবে কোথায়? পরে সে শর্ত দেয়, প্রতিদিন হাজিরা দেবে বড় মসজিদে। আমার বোকাসোকা কুনো স্বভাবের মা ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চাইতেন না কখনও। রাতে খাওয়ার সময় আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ক’ দিন পর ফিরে না আসা পর্যন্ত আর মুখে তোলেননি খাবার, ভোরে উঠেই ছুটেছেন বাড়ি-বাড়ি, সন্তান স্বামী ও জামাতার প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কারও পায়ে পড়ে, কারও হাত ধরে। অনুকূল সাড়া পেয়েছেন কেবল অধ্যক্ষা নাজমা হামিদের কাছ থেকে। মুসলিম লীগের নেতারা আশ্বস্ত করতে পারেননি তাঁকে, জামায়াতের জেলা ও মহকুমার আমির উভয়েই বকেছেন আমার নাম ধরে। জেলা আমির অধ্যাপক আবদুল খালেক আমার শিক্ষক ছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে। পরে আমাকে পরিচয়পত্র দিতে অস্বীকার করেন তিনি। ওই পরিচয়পত্র ছাড়া কোথাও যাওয়া তখন ছিল বিপজ্জনক। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকায় আসি পরিচয়পত্র ছাড়াই। পথে-পথে গাড়ি থামিয়ে চেক করে পাকি সেনারা। তাদের মধ্যে বাঙালিও দেখতে পাই এক-দু’জন। আমার ফুফাত ভাই হেলু (আকরামুল কাদির সিদ্দিকী) চাকরি করতেন রহমান এসোসিয়েটস্-এ। একই অফিসে ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারের উল্লেখ রয়েছে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের “জার্নাল ’৭১” গ্রন্থে। সেখানে আমার নির্যাতিত চেহারার একটি বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মোহসিন হলে আমার সিট ত্যাগের কথা ছিল মার্চ মাসের মধ্যে। ছ’ মাস পরে গিয়ে সেই ত্যাগ সম্পন্ন করি, আমার ২১১ নম্বর রুম দিয়ে আসি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে। স্টেডিয়াম এলাকায় দেখা হয় ফরহাদ মজহার ও হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। ওরা বলে টাঙ্গাইলে আর না ফিরতে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর-ও বলেছিলেন এ কথা। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে যে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাতে চার জনের পরই স্থগিত হয়ে যায় আমাদের এম.এ. মৌখিক পরীক্ষা। পাঁচ নম্বরেই ছিলাম আমি। মনে আছে সেদিন ৪ঠা সেপ্টেম্বর, খবর নিতে যাই কলা ভবনে, দোতলায় আমাদের বাংলা বিভাগে। আমাকে ধরে নিয়ে পাকি সেনারা মেরে ফেলেছে- এ খবরটাই প্রচার হয়েছিল ঢাকায়। শামসুল ইসলামও সে কথাটি লিখেছেন ‘বেঁচে আছি’ (১৯৭৪) গ্রন্থে। বিভাগে উপস্থিত ছিল কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। কথা হয় নূরে আফজা (নিলুফার), সেলিনা, শেফালি, শামীম তরফদার (আজাদ) ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে। নিলুফার জানায়, রফিকুল ইসলাম স্যারকে ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর বোন ভয়েস অভ আমেরিকার মাসুমা খানম চেষ্টা করছেন তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে। দেখামাত্র জড়িয়ে ধরেন স্যারেরা। আনোয়ার পাশা স্যার বলেন, জানো কিভাবে আমি বেঁচে গেছি ২৫শে মার্চ রাতে। লুকিয়েছিলাম খাটের নিচে, ওরা দেখতে পায়নি। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী স্যার চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু না বলে প্রসঙ্গ টানেন আমার লেখালেখির। বলেন, তোমার গল্পের নাম কি সুন্দর... ‘চন্দনে মৃগপদচিহ্ন’...! বিভাগীয় প্রধান তখন মুনীর চৌধুরী স্যার। তাঁর রুমে বসেছিলেন নীলিমা ইব্রাহিম আপা, কাজী দীন মুহম্মদ স্যার। আমাকে দেখামাত্র মুনীর স্যার ব্যাকুল হয়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরেন, আর ছাড়েন না। মনে-মনে জানতাম স্যার আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালবাসেন, সহপাঠীরাও জানত হয়তো। তারা তাই আমাকে একবার পাঠিয়েছিল স্যারের কাছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে এম.এ. পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানাতে। কিন্তু স্যারের সেই ভালবাসা যে কতখানি ছিল তা বুঝেছি সেদিন। প্রথমে বলেন, ‘আমরা শুনেছি তুমি নেই।’ তারপর বলেন, ‘আকরম চলে গেছে।’ আকরম অর্থাৎ সৈয়দ আকরম হোসেন। তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যের বিষয়টি জানতেন স্যার। তারপর বলেন, ‘একটা চিঠি লিখেছে আকরম।’ আহমদ শরীফ স্যারের প্রসঙ্গে বলেন, ‘শরীফ সাহেবের খবর নেই।’ রফিকুল ইসলাম স্যারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠলে স্যার বলেন, ‘চেষ্টা হচ্ছে, এখন কি যে হয়!’ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার এখন কেমন লাগছে?’ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসায় মৃত্যুর ভয় অনেকখানি চলে গিয়েছিল আমার, কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলাম তখন। বলি, ‘স্যার, আমার ভয়-ডর করে না!’ স্যার আবার বুকে জড়িয়ে ধরেন আমাকে। বলেন, ‘তোমার মতো একবার যদি ঘুরে আসতে পারতাম, তাহলে বুকের ধুকপুকুনিটা কমত!’ ২১.০৩.২০১৬
×