ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অবদান

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২৬ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অবদান

মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জাতীয় বীর। তাঁদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ, স্বাধীনতাকামী জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। নয়মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হয়েছে ৩০ লাখ মানুষ, ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বহন করে চলেছে আজো অগণিত মানুষ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন জাতিকে রক্ষার্থে স্থির থাকতে পারেনি আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুবকরা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই দিনেই বাংলার সর্বস্তরের জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। প্রস্তুত হয়েছিল দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়সমূহ। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাতেই ৩২ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পাওয়া যায়। দিনাজপুর জেলার ওরাঁও ও সাঁওতালদের ১০০০ জনের সমন্বয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা এলাকার গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় পনেরো শ’ উপজাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১১৫ জন ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকা থেকেই। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মধ্যেই কমপক্ষে ৫০ জনের অধিক সক্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অনেকে জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য। তাঁদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভূবন সিংহ উল্লেখযোগ্য। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর,কুলাউড়া, বড়লেখা, চুনারুঘাট, মাধবপুর, বৈকুণ্ঠপুর, গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩টি বাগান এলাকার উপজাতি ও চা জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহীদ, আহত ৪৩, নির্যাতিত ৮৩ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকেই। দেশমাতৃকার টানেই উপজাতি মুক্তিযোদ্ধারা কর্মক্ষম হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। কোন অংশেই তাদের অংশগ্রহণকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শক্রর হাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন লড়াই করেই,শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে অনেকে জীবিত রয়েছেন। হারিয়েছেন সহায়সম্পদসহ সবকিছুই। ধর্ষিত হয়েছে অগণিত নারী। আমরা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের কথা কমবেশি সকলেই জানি। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ তারিখে রংপুরের উপজাতি ও বীরজনতা মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর। এদিন সকাল ১০টার দিকে ক্যান্টনমেন্টের কাছে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় সমাবেশ আহ্বান করা হয়। ভোর থেকে মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, বদরগঞ্জ, রানীপুকুর, বুড়িহাট, হারাগাছ, শ্যামপুর, লালবাগ, গঙ্গাচড়া,পাগলাপীর, তারাগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে হাজার হাজার উপজাতিসহ মুক্তিজনতা লাঠি, খুন্তি, বল্লমসহ দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে সেখানে সমবেত হতে থাকে। ঐ সমাবেশে বিপুলসংখ্যক সাঁওতাল উপজাতি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ তীর-ধনুক, বল্লম নিয়ে সেখানে সমবেত হয়। এ সময় পাক হানাদার বাহিনী বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে শত শত মানুষ নিহত হয়। পাক সেনা ২০০ সাঁওতালকে হত্যা করে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেই স্থানেই ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘রক্ত গৌরব’। শহীদ পরিমল দ্রং হালুয়াঘাট বিড়ই ডাকুনি হাইস্কুলের ছাত্র ছিল। ১৯৭১ -এ জুন মাসের দিকে ‘নকলা সেতা’ ধ্বংসের অপারেশনে যান, সেতু ধ্বংস করা হয়। পালানোর সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন রামনগরে। রাজাকাররা তাকে সোপর্দ করে পাক খান সেনাদের হাতে। প্রচুর নির্যাতনের পর ফুলপুরের কংস নদীর পারে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘোড়াঘাটের ফিলিপস-এর সাঁওতালী নেতৃত্বে মাইন সিস্ফোরণে পাক সেনাদের একটি বেডফোর্ড মোটরকার ধ্বংস করা হয়। মিছিলকারীরা নাটোরের প্রতিটি সরকারী অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করে। এদিন নাটোরের কৃষক-মজুর-জেলে-সাঁওতালসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ লাঠি, বর্শা, তীর, ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার পক্ষে এক জঙ্গি মিছিল বের করে। সাঁওতাল, গারো, হাজং, চাকমা, মগ ও অন্যান্য উপজাতী বিষমাখা তীর-ধনুক নিয়ে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অমূল্য সরকার, সুরেন্দ্রনাথ সরকার, নির্মল কুমার সরকার, বরিষা মাহাতো জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদেরও জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল একাত্তরে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল তাদের চৌদ্দপুরুষের ঘর-বাড়ি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবদান ছিল গৌরবের। ময়মনসিংহের গারোদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন কোম্পানি ও প্লাটুন কমান্ডার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী কয়েক গারো মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ কোম্পানি কমান্ডার দীপক সাংমো, মুক্তিযোদ্ধা থিওফিল হাজাং, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিমল দ্রং, মুক্তিযোদ্ধা অনাথ নকরেক, প্লাটুন কমান্ডার যতীন্দ্র সাংমো, সেকশন কমান্ডার ভদ্র মারাক, কমান্ডার অরবিন্দ সাংমা, নারী মুক্তিযোদ্ধা ভেরোনিকা সিমসাং। বৃহত্তর সিলেটের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিলেট অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েক মুক্তিযোদ্ধা হলেনÑ মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র ভৌমিক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় বাউড়ি, শহীদ নিবারণ উরাং, শহীদ রেবতী মাহালী, শহীদ শুভ্রতাঁতী, নারী মুক্তিযোদ্ধা সালগী খাড়িয়া, মুক্তিযোদ্ধা কুলচন্দ্র তাঁতী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পবন কুমার তাঁতী, মুক্তিযোদ্ধা অনীল ছত্রী, মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র বাড়াহক, শহীদ কুনকুনিয়া রুদ্রপাল, নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকণ বিবির নাম উল্লেখযোগ্য। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্বত্য উপজাতিরাও পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষার তাগিদে প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাগারাম মাঝি, দিনাজপুরের শহিদ ফাদার মারান্ডি, নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধা সুরেশচন্দ্র পাহান, মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বনাথ মাঝি, রংপুরের মিঠাপুকুরের বুদু লাকড়া, দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার ওঁরাও মুক্তিযোদ্ধা মনাইচন্দ্র খালকো, দিনাজপুরের কশবা মিশনের দশম শ্রেণীর ছাত্রী নারী মুক্তিযোদ্ধা জসপিন ঢপ্প প্রমুখ। আমাদের দেশ ও বাঙালী জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের গৌরবময় ভূমিকাকে যথাযথভাবে সম্মাননা জানানো।
×