ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পুলিশ সদস্যদের

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৬ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পুলিশ সদস্যদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে প্রথম আক্রান্ত হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। একই সময়ে পুলিশ সদস্যরা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার বার্তা সারাদেশের থানাগুলোতে প্রেরণ করেন। জানিয়ে দেয়া হয়, তাঁরা পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। সহকর্মীদের এই প্রতিরোধযুদ্ধের কথা জানতে পেরে দেশের বিভিন্ন থানায় কর্মরত বাঙালী পুলিশ সদস্যরা অনুপ্রাণিত হন। তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আবদুস ছাত্তার ঠাকুর তাঁদেরই একজন। রংপুরের কাউনিয়া থানার তৎকালীন এসআই ছাত্তার ঠাকুর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। দ্রুতই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে থানার সকল অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিজে ধরা পড়েন পাকিস্তানীদের হাতে। ঘাতকরা নির্মম অত্যাচার চালায় তাঁর ওপর। একাত্তরের ২ এপ্রিল ছাত্তার ঠাকুর শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মরণে রাজারাবাগে যে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, সেখানে শহীদদের নামের তালিকায় আবদুস ছাত্তার ঠাকুরের নাম উৎকীর্ণ আছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত আমন্ত্রণও পান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তালিকাতেই ঠাঁই হয়নি ছাত্তার ঠাকুরের। পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠানো তাদের কাজ নয়। এটি করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পুলিশ কেবল সুপারিশ করতে পারে। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যে পর্যাপ্ত দালিলিক তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন, তা পুলিশ দফতর বা সংশ্লিষ্ট শহীদ পরিবারের কাছে পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টির আশু কোন সমাধান নেই। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ সার্ভিসে কর্মরত বাঙালী-অবাঙালীদের মোট সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন। এদের মধ্যে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্য প্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে এবং অস্ত্র-গুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র যুদ্ধে। যারা তখনও চাকরিতে রয়ে গেলেন, তারাও গোপনে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। ২৫ মার্চ রাতে রাজারাবাগে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে ১৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য শহীদ হন। ধারণা করা হয়, যুদ্ধের নয় মাসে ১১০০ পুলিশ সদস্য শহীদ হন। তবে পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী এই সংখ্যা ৭৫১ জন। তবে এদের মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শাহাদাতবরণ করেছেন, খোদ পুলিশই তা জানে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমিটির সদস্য সচিব এবং অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (অর্থ ও বাজেট) আবিদা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে থানাগুলো। ফলে পুলিশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল আগুনে পুড়ে বা অন্য কোনভাবে নষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার দালিলিক প্রমাণ গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়নি। তাই ৪৫ বছর পর পুলিশের কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শাহাদাতবরণ করেছেন তার সপক্ষে প্রমাণ যোগাড় করা কঠিন। এমনকি সংশ্লিষ্ট অনেক শহীদ পুলিশ পরিবারের সদস্যের কাছেও কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নেই। তবুও শহীদ পুলিশ পরিবার প্রতীক্ষায় দিন গোনে যদি কোনদিন মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলে! তবে প্রতীক্ষার শেষ আপাতত হচ্ছে না শহীদ এসআই ছাত্তার ঠাকুরের পরিবারের সদস্যদের। বাবা যখন শহীদ হলেন, এক ছেলে আর তিন মেয়ের তখনও বুঝার বয়স হয়নি। পরে ১৯৯৬ সালে বিজয় দিবসের রজতজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো আমন্ত্রিত হন শহীদ আবদুস ছাত্তার ঠাকুরের ছেলে মিজানুর রহমান ঠাকুর। এরপর ১৯৯৮ সালের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শকের কার্যালয় এবং ১৯৯৯ সালের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে মিজানুর রহমান ঠাকুরের ২৬২/১ রায়েরবাজার সুলতানগঞ্জ রোডের ঠিকানায় আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়। মিজানুর রহমান ঠাকুর ওই সব অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেনও। তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় হয়ত তাঁর বাবার নামটিও উঠবে। কিন্তু গত বছর তিনিও চলে গেলেন তাঁর শহীদ বাবার সান্নিধ্যে! সম্প্রতি রায়েরবাজারে শহীদ ছাত্তার ঠাকুরের নিকট স্বজনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বসার ঘরের দেয়ালে মিজানুর রহমানের দুটি ছবি টাঙানো। আওয়ামী লীগের প্রথম আমলের দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নাসিমের কাছ থেকে সন্তান হিসেবে শহীদ বাবার জন্য সম্মাননা নিচ্ছেন। ছবিতে তাঁর গবির্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখভঙ্গি স্পষ্ট। ছবির দিকে তাকিয়ে ছাত্তার ঠাকুরের ছোট ভাইয়ের ছেলে স্বপন ঠাকুর বললেন, মিজান ভাই গর্ব করে তাঁর মেয়েকে বলতেন, তোর দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুই মুক্তিযোদ্ধার নাতনি। কিন্তু জীবদ্দশাতেও বাবার মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায় করে যেতে পারেননি। পুলিশ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে পারে না। এটা খুবই বেদনার। মিজানুর রহমান ঠাকুরের একমাত্র মেয়ে মারজান রাফা অর্পা রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বাবার মতো তিনিও চান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও দাদা যেন রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকু পান। রেকর্ড অনুযায়ী, একাত্তরে নয় মাসের যুদ্ধে দেশজুড়ে পুলিশের ২৭টি ইউনিটের ৭৫১ জন সদস্য শহীদ হন (সূত্র : ডিটেকটিভ-বিজয় দিবস সংখ্যা ১৯৯৪)। এর মধ্যে রংপুর ইউনিটে শহীদ হন ২৩ জন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মরণে রাজারাবাগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের চারপাশে বিভিন্ন ইউনিটে শহীদ হওয়া পুলিশ সদস্যদের নাম খোদাই করা আছে। সরেজমিন দেখা যায়, স্মৃতিসৌধে রংপুর ইউনিটের শহীদদের খোদাই করা নামের তালিকায় চার নম্বরে আছে এসআই আবদুস ছাত্তার ঠাকুরের নাম। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (অর্থ ও বাজেট) আবিদা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, আবদুস ছাত্তার ঠাকুর শহীদের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এটিও কম কথা নয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য তাঁর পরিবারের সদস্যদের পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনের পরামর্শ দেন তিনি।
×