ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি উঠেছে এবার;###;শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিরুদ্ধে সর্বত্র তীব;###;ঘৃণা আর ধিক্কার

আজ সেই কালরাত ॥ ইতিহাসের বিভীষিকাময় গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৫ মার্চ ২০১৬

আজ সেই কালরাত ॥ ইতিহাসের বিভীষিকাময় গণহত্যা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্রের হাল্কা হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। দিন শেষে এলো রাত। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। এ নাম দিয়েই মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক নেমে এলো। অকস্মাত যেন খুলে গেল নরকের সব ক’টি দরজা। বিভীষিকা ছড়িয়ে দিকে দিকে ছুটে গেল সাঁজোয়া গাড়ির বহর। রাতের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে গর্জে উঠল বন্দুক, কামান আর ট্যাঙ্ক। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক। আজ সেই ভয়াল ও বীভৎস কালরাত্রির স্মৃতিবাহী ২৫ মার্চ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। তবে এবার জাতির সামনে এই ভয়াল দিনটি এসেছে একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। এবার সর্বত্র প্রবল দাবি উঠেছে- ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার। একই সঙ্গে স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-ধিক্কারের মাত্রাও এতটুকু কমতি নেই। ভবিষ্যতে যাতে কেউ দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদের সংখ্যা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে না পারে- সে জন্য সরকার তরফে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো হলোক্যাস আইনের মতোই করা হচ্ছে এই নতুন আইন। একদিকে একাত্তরের হন্তারক এদেশীয় দালালদের মৃত্যুদ- কার্যকর, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য নতুন প্রজন্ম আজ নতুন শপথে বলীয়ান। ২৫ মার্চ সেই রক্তাক্ত রাতে আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছিল। এক সময় অগ্নিবর্ণের ধূম্রকু-লী ছড়িয়ে পড়ল, পর মুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। উত্তাল দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালীর জীবনে। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। হতচকিত বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ভূখ-ে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় রাতের অন্ধকারে পাক জল্লাদবাহিনী এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই মৃত্যু তার রেখে গেছে করাল স্বাক্ষর। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে এলো শহরের আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান শিখা। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালী জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের বিভীষিকাময় ভয়াল ও নৃশংসতম বর্বরতা। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে উঠেছিল নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালী নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালীকে। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। একাত্তরের এ দিনে চির আকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার সোঁদা মাটি। ঘুমন্ত শিশু, বধূ, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হয়েছিল মানব ইতিহাস। সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান- হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। নিধনযজ্ঞে যোগ দিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মান-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই। স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকসেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস হত্যাকা-ই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান শেরাটন হোটেল) সামনে সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদাররা। এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। এবার জাতির জীবনে ভয়াল ২৫ মার্চ কালরাত এসেছে এক অন্যরকম আবহে। একাত্তরে যেসব এদেশীয় রাজাকার-আলবদর-আলশামস ওই রাতে গণহত্যা চালাতে পাকহানাদারদের সহযোগিতা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল, লুটপাট-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলÑ সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের অনেককেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। কার্যকর হয়েছে মৃত্যুদ-ের। বেশ ক’জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কারাগারের ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আগামী দু’তিন মাসের মধ্যে রাজাকার শিরোমনি মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেমের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে- এমনটাই প্রত্যাশা করছে দেশবাসী। কী ঘটেছিল সর্বনাশা সেই ভয়াল রাতে ॥ সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমান করে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কৃষ্ণপক্ষের রাত। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিক- তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক। রাত ১০টা ৩৫। ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঘিরে ফেলেছে। রিসেপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিলÑ বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশী সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। কার্ফুর কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাঙ্কের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুমে জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচী টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরে পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচার। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মার্কিন ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। প্রতিটি রুমে রুমে ঢুকে পড়ে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ জন হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধান্ত শকুনিরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। পাক জান্তারা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটি চাপা দিয়েছিল পাক সেনারা। তার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনির দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল। পাক জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র্র মানুষকে। চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহীদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাকি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যক্ষ করেছিল শহরের সব জায়গায়। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দফতরে পাকিসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালী পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দফতর। সে রাতে ১১শ’ বাঙালী পুলিশের রক্ত ঝরিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। অন্যদিকে নগরজুড়েও রাতভর চলেছে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তা-ব। হতচকিত বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় ঢাকা। কেঁদে ওঠে শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিকে কেবল প্রজ্বলিত অগ্নিকা-, ধ্বংস আর মর্মন্তুদ চিৎকার। মধ্যরাতেই ঢাকা তখন লাশের শহর। দেশের বড় বড় শহরেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকি সেনারা। অবশ্য এই পরিস্থিতিতেও বাঙালী ছাত্র-জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ঢাকার ফার্মগেট থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় এলাকার চারপাশে সর্বত্র এই প্রতিরোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল চট্টগ্রামেও। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেননি অকুতোভয় বাঙালীরা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ॥ ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর শুভাকাক্সক্ষীরা বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানী বাহিনী তাঁকে না পেলে একজন বাঙালীকেও বাঁচতে দেবে না। সে রাতে তাঁকে না পেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়া হতো পুরো শহর। ওইদিন জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ইয়াহিয়া বললেন, ‘মুজিব দেশের অখ-তা ও নিরাপত্তার ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে। দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আজ আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এরপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে করাচীর পথে ঢাকা ত্যাগ করেন জল্লাদ ইয়াহিয়া। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।’ রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাংক সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই নিজেরই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙ্গর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় এদিকে চট্টগ্রামে তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকের [সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) রফিকুল হক বীরউত্তম এমপি] নেতৃত্বে ষোলশহর এলাকায় গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ ব্যূহ। সারাদেশেই যখন বাঙালীর প্রতিরোধের আগুন, তখন ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে বাঙালীর মধ্যে চট্টগ্রামে কর্মরত সিনিয়র অফিসার মেজর জিয়া তার কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে রওনা হন। পথে অনেক স্থানের বাঙালীর দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে রাত ৯টার দিকেই পাকি হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনানিবাসে বাঙালীদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করা হয় সহস্রাধিক বাঙালী সেনা ও তাদের পরিবারের সদস্যকে। ক্যাপ্টেন রফিকের প্রতিরোধের সংবাদ এবং সেনানিবাসে হামলার ঘটনা শুনে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান যখন মেজর জিয়ার সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো অবস্থায় দেখে ঘটনা খুলে বলেন, তখন মেজর জিয়া তাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে তিনি তার নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেজর জিয়া যখন রাত ১টার দিকে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন শমসের মবিনসহ অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন ততক্ষণে পাকি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধও ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এদিকে গাজীপুরেও শফিউল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় তীব্র প্রতিরোধ। এরপর আর বীর বাঙালীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সাগর রক্তের ঢেউ পেরিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ ও আকাক্সক্ষার ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, সোনার বাংলা। কর্মসূচী ॥ জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার বীর বাঙালীদের। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক সংগঠন ‘কালরাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনা সভা, শোকসভা ও রাতে মোমবাতি প্রজ্বলন। শোকাবহ জাতি কালরাত্রি বাঙালী জাতি ঘৃণা ও ধিক্কার জানাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ২৩ বছরের ন্যায় এবারও ভয়াল সেই কালরাত্রি স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল বের করবে। স্বাধীনতা ও গণহত্যার ৪৫তম বার্ষিকীতে ৪৫টি মশাল প্রজ্বলন ও আলোর মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করা, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা। দাবি জানাবেন, সরকারীভাবে ২৫ মার্চকে ঘোষণা করা হোক ‘গণহত্যা দিবস।’ ‘গণহত্যার কালরাত্রি’ উপলক্ষে আলোচনাসভায় সূচনা বক্তব্য দেবেন সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের অন্যতম উপদেষ্টা সাংবাদিক কামাল লোহানী। আলোচনা সভা শেষে শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিলটি জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শেষ হবে। প্রতিবছরের মতো এবারেও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১ বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী গণহত্যা শুরুর ভয়াল রাত ও কালরাত্রি শেষে স্বাধীনতার পথে আলোকযাত্রার মুহূর্তকে বিস্তারিত অনুষ্ঠানমালায় স্মরণ করবে। আজ শুক্রবার রাত ১১টায় ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ‘শিখা চিরন্তন’সংলগ্ন বেদিতে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে। দেশাত্মবোধক নাচ, গান ও কবিতা আবৃত্তির এক ঘণ্টাব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে প্রথম প্রহর অর্থাৎ রাত ১২টায় এক মিনিটের নীরবতা ও নিষ্প্রদীপ মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। এরপর অন্ধকারের তমসা ভেদ করে স্বাধীনতার আলোর পথে যাত্রা। এ পর্যায়ে নতুন প্রজন্মের হাতে মশাল ও জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করবেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাগণ। এবারের অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম কয়েক নারী মুক্তিযোদ্ধা নতুন প্রজন্মের হাতে জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করবেন। বক্তব্য রাখবেন ফোরামের চেয়ারম্যান সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, ভাইস-চেয়ারম্যান সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী, মহাসচিব লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব প্রমুখ। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবিতে আজ মানিকমিয়া এ্যাভিনিউতে বিস্তারিত কর্মসূচী পালন করবে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সন্ধ্যায় আলোর মিছিল এবং গণহত্যার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জাদুঘর প্রাঙ্গণে কালরাত্রি স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হবে। শিশু একাডেমিও ভয়াল দিনটি স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বলন ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া অজস্র সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন কালরাতের শহীদদের।
×