ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ তুমি কেমন তুমি!

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৪ মার্চ ২০১৬

এ তুমি কেমন তুমি!

বিদেশী পুঁজির দাপটে বদলে যাচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্রের নিজস্ব আঙ্গিক, ভাষা। নিজেদের ছবি বলতে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে অনেকবার। প্রতীক আকবর লিখেছেন বাংলা ছবির সাম্প্রতিক ট্রেন্ড নিয়ে হলিউডের ‘ডেডপুল’ যারা দেখেছেন, শুরুতেই চমকে যাওয়ার কথা। মৃদু আওয়াজে ভেসে আসছে হিন্দী ভাষার পুরনো একটি গান! বিস্ময় জাগবে, প্রশ্নও- হলিউডের ছবিতে হিন্দী গান কেন? একটু সময় দিলে উত্তর পাবেন দর্শক নিজেই। অনেক যুক্তি দিয়েই গানের ব্যবহার এবং দৃশ্য বুনেছেন পরিচালক। ঘটনাটি এমন- এক ভারতীয়, জীবিকার তাগিদে ট্যাক্সি চালায়, তার ট্যাক্সি করেই রওনা হয় ডেডপুল। এ যাত্রাপথেই ডেডপুল আর ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথোপকথন, ব্যাকগ্রাউন্ডে হিন্দী গান। এ সূত্রে আরেকটি ছবির প্রসঙ্গও টানা যায়। গত বছরের শেষভাগে মুক্তি পাওয়া ‘এভারেস্ট’-এর প্রথমাংশে অভিযাত্রী দল নেপালে প্রবেশের পর হিন্দী গান শোনা যায়। এটারও কারণ আছে। নেপালে, সে দেশের ছবির চেয়ে বলিউডের বাজার ভাল। তাই তারা নেপালী গান না শুনে হিন্দী বেশি শুনছে। অনেকটা আমাদের মতো। দুটি ছবিতে দুটি হিন্দী গান ব্যবহারের প্রেক্ষাপট এতই প্রাসঙ্গিক যে, এর অন্য কোন অর্থ বের করতে চাওয়ার ইচ্ছা দর্শকদের হবে না। সঙ্গে বাজার ধরতে চাওয়ার ইচ্ছাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ‘ডেডপুল’-এর তিন প্রযোজকের অন্যতম সাইমন কিনবার্গ। এর আগে তিনি প্রযোজনা করেছেন ‘মার্শিয়ান’, ‘সিনড্রেলা’, ‘শার্লক হোমস’, ‘মিস্টার এ্যান্ড মিসেস স্মিথ’-এর মতো ছবি। এত সফল একজন প্রযোজক, তিনিও চান তার ছবি ব্যবসা করুক পৃথিবীজুড়ে। আর ‘এভারেস্ট’-এর ছয় প্রযোজকের কেউই কিনবার্গের মতো বিখ্যাত নন। বাজার ধরার আগ্রহ তাদের আরও বেশিই থাকার কথা। বাজার খোঁজা, দখল এবং আধিপত্য- পুঁজির চরিত্রই এমন। এ যুক্তিতে, অবাক হওয়ার কিছু থাকে না, যখন ওয়াজেদ আলী সুমন, সৈকত নাসির কিংবা জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো বাংলাদেশের ছবির ভাষায় কথা বলে না। প্রশ্ন জাগে, নির্মাণের এমন শৈলী আগের ছবিগুলোতে কেন দেখাননি তারা? পোস্ট প্রডাকশনেই বা এত ভাল কাজ হয়নি কেন আগে? অনেকে প্রশ্ন তোলেন, এগুলো কি তাহলে অন্য কেউ নির্মাণ করেছেন? এই ট্রেন্ড শুধু এ দেশেই নয়, বাইরেও আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা পার্ক চ্যান উকের প্রথম ছবি ‘মুন ইজ দ্য সান’স ড্রিম’, মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। ছবিটি দেখে সহজেই বলে দেয়া যায় এটি কোন অঞ্চলের সিনেমা। কিন্তু একই পরিচালকের হাতে যখন হলিউডের পুঁজি আসে, তখন তিনি নির্মাণ করেন ‘স্টোকার’। পরিচালক দক্ষিণ কোরিয়ার হলেও ছবিতে ব্যবহৃত ভাষায় আসে পরিবর্তন। পরিচালক পার্ক চ্যান উক চাইলেও পারেননি হলিউডের অর্থে তার আগের ছবির ভাষায় কথা বলতে। একইভাবে অস্কারজয়ী আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতুর উদাহরণ টানা যেতে পারে। পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘পাগলা দিওয়ানা’, ‘আজব প্রেম’ এর সঙ্গে ‘সুইটহার্ট’-এর পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। তার চেয়েও বেশি পার্থক্য পাওয়া যায় একই পরিচালকের যৌথ প্রযোজনার ‘অঙ্গার’-এর ভাষার। একইভাবে পার্থক্য সৈকত নাসিরের ‘দেশা দ্য লিডার’-এর সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার ‘হিরো ৪২০’-এর। ‘দেশা দ্য লিডার’ ছবিতে ব্যবহৃত ভাষা যতটা বাংলাদেশের, ‘হিরো ৪২০’ ততটাই বাংলাদেশের নয়। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জাকির হোসেন রাজুর ‘নিয়তি’র ‘ঢাকাই শাড়ি’ গানে নায়িকা এবং নাচের সহশিল্পীদের পোশাক কোনভাবেই বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে না। পরিচালক হয়ত বলতে পারেন, গানের দৃশ্যধারণ নৃত্যপরিচালকের দায়িত্ব। কিন্তু ছবিটির নির্মাণশৈলীতে কেন এতদিনের রাজুকে পাওয়া যায় না, তার উত্তর পরিচালককে তো দিতেই হবে। উল্লিখিত সব বাংলা ছবিই যৌথ প্রযোজনার। টাকার উৎস খুঁজলেই বোঝা যাবে, এসব পরিচালকদের আগের সিনেমায় ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে এসব ছবির মিল কেন পাওয়া যাচ্ছে না! এভাবেই যদি নিজস্বতা-বর্জিত ভাষার চলচ্চিত্র জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে, তাহলে বলতেই হবে, চলচ্চিত্র সংস্কৃতির নতুন রূপান্তর সন্নিকটে। মূলত পুঁজি বা পুঁজি সরবরাহকারীর ইচ্ছায়ই তাদের ছবির ভাষা যাচ্ছে বদলে। এসব ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী-প্রোডাকশন ক্রু, পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ এবং প্রযোজনার একটা বড় অংশের সাপোর্ট আসে কলকাতা থেকে। তাই পুঁজির জোরে গল্প, দৃশ্য, পোশাক এবং সংলাপ নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই। বাংলাদেশে ছবিগুলো যৌথ প্রযোজনা দেখানো হলেও কলকাতায় কিন্তু সেগুলো ধরা হয় স্থানীয় ছবি হিসেবেই। প্রত্যেক প্রযোজকই চান এমন ক্ষেত্রে লগ্নি করতে, যেখান থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে নিরাপদ। এর বিপরীত উদাহরণও অনেক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো চলচ্চিত্র শিল্পে পুঁজির দখলদারিত্বের সীমা নেই। পুঁজিবাদীদের দখলদারিত্বে না থেকেও নিজস্ব ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলন আগেও হয়েছে। তেমন একটি নতুন সময়ের অপেক্ষা।
×