ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টি ইসলাম তারিক

মাঠের রাজা এমেকা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৩ মার্চ ২০১৬

মাঠের রাজা এমেকা

রাজার ছেলে রাজাই হবে এটাই নিয়ম। রাজ্যের লোভ কখনই দেখেননি। দেখেননি কোন রাজ্য নিয়ে স্বপ্ন। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করার পরও কখনই রাজ্যের মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল প্রাণের প্রিয় ফুটবলকে ঘিরে। আর তাই তো এই ফুটবলকেই শাসন করেছেন অবলীলায়। যেখানেই খেলেছেন পুরো মাঠকে যেন ‘রাজ্যের রাজার’ মতোই শাসন করেছেন। তিনি এমেকা ইউজুগো। ঢাকা এবং কলকাতার ফুটবল দর্শকদের কাছে যিনি ‘এমেকা’ হিসেবেই পরিচিত। এমেকার পরিবার একটি শাসক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তার পিতামহ মোনাকার চেয়ে একটু বড় রয়েল পরিবার থেকে এসেছিলেন। যিনি রাজা ছিলেন। যার নাম ছিল ইউজুগো। পরবর্তীতে তার পিতামহ মারা গেলে এমেকার বাবা রাজা হন। যখন তারা ছোট। এমেকার বাবা সে সময় এক মেয়ে এবং পাঁচ ছেলে রেখে মারা যান ২০১৪ সালে । এমেকা ইউজুগো একজন দক্ষ মিডফিল্ডার এবং স্ট্রাইকার হিসেবে ঢাকা এবং কলকাতায় দারুণভাবে পরিচিত ছিলেন। আফ্রিকার দেশ নাইজিরিয়ার এই চৌকস ফুটবলার বাংলাদেশের ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন সুনামের সঙ্গে। কলকাতার সেরা ক্লাবগুলোতেও খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। যে কারণে দুই বাংলার দর্শকদের কাছেই সমান জনপ্রিয় এমেকা। আশি ও নব্বইয়ের দশকের এই তারকা ফুটবলারের সঙ্গে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অনেক বিষয়ে খোলামেলা কথা হয়। সে সবের চুম্বক অংশ ও ঢাকার মাঠে তার খেলার চালচিত্র নিয়ে এই প্রয়াস। ফুটবল কখন থেকে শুরু? এমন প্রশ্ন করলে এমেকা হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার মা আজও বলেন আমি যখন মায়ের গর্ভে ছিলাম তখন থেকেই ফুটবল খেলতাম’। ফুটবলের প্রতি ছিল অদম্য নেশা। সময় আর সুযোগ হলেই বল নিয়ে একাকীই ছোটাছুটি করতেন। তবে ফুটবলে তার পরিস্ফুটন ঘটে ১৯৮৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য ভারতে থাকাকালীন সময় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ফুটবলে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন এমেকা। আন্তর্জাতিকভাবে খেলেন বাংলাদেশসহ মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক, হাঙ্গেরি, স্পেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পেরুতে। পরবর্তীতে যোগ দেন ভারতের কলকাতা মোহামেডানে। নেহেরু গোল্ড কাপে অসাধারণ খেলার কারণে ফুটবল কর্মকর্তাদের নজরে পড়েন। এমেকার বল কন্ট্রোলিং এবং ডেলিভারি ছিল দেখার মতো। ঢাকা আবাহনীর সঙ্গে এমেকার বিবাদ কলকাতাতে সেই ১৯৮৬ সাল থেকে। ১৯৮৬ সালে আই এফ এ শিল্ডে এমেকা কলকাতার ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে খেলেন। ঢাকা আবাহনী ওই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। আবাহনীকে এমেকার দেয়া ১-০ গোলে হারিয়েছিল কলকাতা ইস্টবেঙ্গল। ১৯৮৭ সালে কলকাতা মোহামেডানের হয়ে ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবল খেলতে। অত্যন্ত টাফ এবং পাওয়ার ফুটবল খেলতেন এমেকা। তার পায়ে বল থাকলে খুব সহজে কেউ কেড়ে নিতে পারত না । বাংলাদেশ নীল দল যা তখন দর্শকদের কাছে ঢাকা আবাহনী হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই নীল দলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র হয় ম্যাচটি। ওই ম্যাচেও এমেকা গোল করেন। ঘটনাবহুল ওই ম্যাচে এমেকা বেশ নাজেহাল হয়েছিলেন। টুর্নামেন্ট শেষে মোহামেডান এবং আবাহনী দু’দলই চেয়েছিল এমেকাকে। এমেকা আবাহনীর কথায় সায় দেয়নি। তিনি যোগ দেন ঢাকা মোহামেডানে। ক্লাব ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান যেমন চিরশত্রু তেমনি এমেকা হয়ে যান আবাহনীর চিরশত্রু! ওই সময় কোচ হিসেবে ঢাকা মোহামেডানে নাসের হেজাজি যোগ দেন। মোহামেডান তখন দুর্দান্ত দল। সাব্বির আর এমেকার জুটি যেন দেশ সেরা। ১৯৮৬, ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে পুরো মোহামেডান ছিল অপ্রতিরোধ্য। এমেকার ফর্ম তখন তুঙ্গে। ওই বছরই যোগ দেন তিনি ঢাকা মোহামেডানে। ১৯৮৭ সালে এমেকা মোহামেডানের পক্ষে ৯টি গোল করেন। ১৯৮৮ সালে কোরিয়াতে নিজ দেশ নাইজিরিয়ার পক্ষে অলিম্পিক ফুটবলে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে কলকাতায় নেহেরু গোল্ড কাপে কলকাতা মোহামেডানের পক্ষে খেলে ম্যান অফ দা টুর্নামেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ওই বছর এমেকাকে ডেনমার্কের একটি দল ডেনমার্ক লীগে খেলার জন্য অন্তর্ভুক্ত করে। এমেকা প্রসঙ্গে সাবেক জাতীয় ফুটবলার কায়সার হামিদ বলেন, এমেকা মোহামেডানের জন্য সব সময় উদার। তিনি মোহামেডানকে এবং মোহামেডানের সমর্থকদের জীবন দিয়ে ভালবাসেন। মোহামেডানে যখন খেলতেন তখন শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং মাঠের মধ্যে খুবই সিরিয়াস ছিলেন। কোন সময়ে এবং কার বিরুদ্ধে ফুটবলকে বেশি উপভোগ করতেন? এমেকা এই প্রশ্নের উত্তরে জানান, তিনি জানান বাংলাদেশে খেলার সময় ফুটবলকে খুব বেশি উপভোগ করতেন। তিনি হাসি দিয়ে জানান, আবাহনীর বিরুদ্ধে গোল করতে এবং জয়লাভ করতে তার খুব ভাল লাগত। এমেকা টেনে আনেন বিশেষ করে ১৯৮৭ সালের লিগের সময়কার কথা। ওই সময়ের কথা তার কাছে এখনও স্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে এমেকা বলেন, আবাহনী সেই লিগে মোহামেডানের চেয়ে দুই পয়েন্ট এগিয়ে। মোহামেডান আবাহনী ম্যাচ ড্র হলে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন। আর মোহামেডান কে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে আবাহনীকে দুই বার হারাতে হবে। এমন এক সমীকরণে সবাই ধরেই নিয়েছিল আবাহনী চ্যাম্পিয়ন। অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন ওই ম্যাচ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সে সময় ফুটবলার দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘অলৌকিক কিছু না ঘটলে আবাহনীই চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু আমরা সবার ধ্যান ধারণাকে পাল্টে দিয়ে অবশেষে লড়ায় করেই প্রথমে ৩-২, পরে রিপ্লে ম্যাচে আর্মি স্টেডিয়ামে ২-০ গোলে আবাহনীকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হই। আবাহনীকে দুইবার হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের সাধ যেন মধুর মতো। সেগুলো মনে হলে আজও আমি শিহরিত হয়ে উঠি।’ বাংলাদেশ ফুটবলে কোন দুঃখ আছে কি? এমেকা জানান, ১৯৮৮ সালের লিগের শেষ ম্যাচে মিরপুর স্টেডিয়ামে মোহামেডান ড্র করে পর পর তিনবার অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের স্বাদ গ্রহণ করে। ওই দিন আবাহনীর এক সমর্থক আমাকে ছুরিকাহত করেন। ফুটবলের জন্য এটা একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা। এ বিষয়টা আমাকে এখন পীড়া দেয়। ফুটবল ক্রেজি হওয়া ভালো তবে যে ক্রেজ ফুটবলকে পিছিয়ে দিবে সে ক্রেজ থাকা মঙ্গলজনক নয়। কোচ হিসেবে একবার আপনাকে বাংলাদেশে দেখা গেছে। পরবর্তীতে কি আর দেখা যাবে? এমেকার জবাবÑহ্যাঁ, আমি ২০১২ সালে মোহামেডানের কোচ হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলাম। কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য পরের বার দেশে ফিরে যাই। সুযোগ হলে আবার আসতে পারি। তবে অনুর্ধ ১৭ দলের দায়িত্ব দিলে এবং বাফুফে যদি আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করে। যেমন বিদেশে ম্যাচ খেলানোর ব্যবস্থা ও সে দলকে ইউরোপ বা দক্ষিণ আমেরিকাতে যদি ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। আমি অবশ্যই ওই দলকে এমন ভাবে তৈরি করতে পারব যে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটা তাক লাগানো দলে পরিণত হবে। পরবর্তীতে সেই দলটা দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারবে খুব তাড়াতাড়ি। তাছাড়া একটা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলে পরিণত হবে। অনেক দেশেই খেলেছেন, কোন দেশে খেলে আপনি তৃপ্ত? এমেকা জানান, তার ফুটবল প্রতিভা বিকশিত করার জন্য বহু দেশ সফর করেছেন। যে সময়টাতে তার ফুটবলের উত্থান প্রয়োজন ছিল ঠিক সে সময়তাতেই তিনি বাংলাদেশে কাটান। পরে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ডেনমার্কসহ অনেক দেশেই খেলেছেন। ভাল খেলার জন্য যার ফলাফল ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে নাইজিরিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা। সে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে এমেকার দুটি গোলও ছিল। অবশ্যই বাংলাদেশে খেলে আমি তৃপ্ত এমনটাই বলেন এমেকা। বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড়ের খেলা আপনাকে আকৃষ্ট করেছে? নিঃসন্দেহে রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির ছিলেন একজন অসাধারণ খেলোয়াড়। তার খেলা আমার ভাল লাগত। ১৯৮৮ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে অজ্ঞাত কারণে এমেকাকে মাঠে নামানো হয়নি। সে খেলায় মোহামেডান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর কাছে ১-০ গোলে হেরে যায়। আবাহনীর কাছে পরাজয়ে মোহামেডান সমর্থকরা যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমাকেও সমান ভাবেই ব্যথিত করেছিল। এমেকার একটা রেকর্ড আছে। খেলোয়াড় এবং কোচ থাকা অবস্থায় তিনি আবাহনীর বিরুদ্ধে কখনই কোন ম্যাচে হারেননি। তাছাড়া ১৯৮৮-৮৯ লিগের আবাহনীর বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ ছাড়া আবাহনীর বিরুদ্ধে সব খেলায় তার গোল আছে। ১৯৮০-৯০ দশকে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা যেমন ছিলেন ক্রেজি তেমনি এমেকাও তার খেলা এবং খেলার অঙ্ক দিয়েও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একজন খেলোয়াড় হিসেবে তার ক্রেজিনেসও কম ছিল না। এমেকার একটি কন্যা সন্তান আছে। স্ত্রী এবং এক কন্যা সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। ফুটবলের সঙ্গে এখনও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। রাজপরিবারে জন্ম নিয়েও রাজ্যের মোহ যাকে কখনই আকৃষ্ট করতে পারেনি। যার মনের মধ্যে সর্বদাই ছিল একজন আদর্শ ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। সেই এমেকা ফুটবলার হয়েই দেশের পক্ষে খেলেছিলেন অলিম্পিক এবং বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে। নাইবা হউক রাজ্যের রাজা কিন্তু দাপটের সঙ্গে ফুটবল ক্রীড়া শৈলী দিয়ে শাসন করেছেন ফুটবল মাঠকে। আর কেউ মনে রাখুক বা নাই রাখুক বাংলাদেশের ফুটবল প্রিয় সমর্থকরা তাকে স্মরণ করবেন অবলীলায়। আর বাংলাদেশ ফুটবলের স্বর্ণযুগের স্মৃতিচারণ করতে গেলে নিশ্চিতকরেই চলে আসবে নাইজিরিয়ার এই দীর্ঘদেহী খেলোয়াড় এমেকা ইউজুগোর নাম।
×