ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবশেষে দুর্নীতির দায়ে তিতাসের এমডি অপসারিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২১ মার্চ ২০১৬

অবশেষে দুর্নীতির দায়ে তিতাসের এমডি  অপসারিত

রশীদ মামুন ॥ অনিয়ম দুর্নীতির মধ্যেই দায়িত্বে অবহেলার কারণে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদ ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হলো। বনানীতে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে তিতাসের বিরুদ্ধে। যদিও এর আগেই মন্ত্রণালয় গঠিত একটি তদন্ত কমিটি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পায়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নেতৃত্বে তিতাসের একটি সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন করে অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ রবিবার দুপুরে জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু বনানীর ঘটনার জন্যই তাকে সরানো হচ্ছে এমন নয়, এর আগেই তদন্ত কমিটি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। প্রথা অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা দুর্নীতির জন্য তার বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রী আরও যোগ করেন, বনানীর ঘটনা জানার পর আমি রাত তিনটার সময় ফোন করে গ্যাস লাইন বন্ধ করতে বলি, অথচ তার তিন দিন আগে থেকে তিতাসকে জানানোর পরও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। দায়িত্বের প্রতি কতটা উদাসীন হলে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করতে পারে জেনেও তারা চুপ করে থাকে। বিষয়টি বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করেন তিনি। নসরুল হামিদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হবে। তবে পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রত্রিকায় শীঘ্রই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। আমরা সরকারী কোম্পানিগুলোর আধুনিকায়ন চাই। সুতরাং পোশাদারিত্ব বজায় রেখে কর্মীরা কাজ করতে পারেন তা দেখা হবে। রাত পৌনে নটার দিকে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ জানান, ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (ভিজিলেন্স) মীর মশিউর রহমানকে। আর নওশাদকে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকা-নারায়ণঞ্জ, নরসিংদী এবং আশপাশের এলাকায় সব বড় অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সিন্ডিকেট অবাধে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিত। রাষ্ট্রীয় তহবিলে অর্থ জামা দেয়ার বদলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদকে মাসিক বখরা দিতে হতো। তিতাস পরিচালনা পরর্ষদের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে ব্যবসায়ীরা কর্মকর্তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে চেকের মাধ্যমে মাসোহারা দেয়ার প্রমাণ হাজির করেন। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে জানার পরও তা না কাটার নির্দেশ দিতেন সরাসরি ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদ নিজে। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হরিলুটের কোন অধিকার নেই একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত অক্টোবরে তিতাস বোর্ড সভায় তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন তৎকালীন তিতাসের চেয়ারম্যান জ্বালানি সচিব আবু বক্কর সিদ্দিক। বোর্ড সভায় ওই সময় সচিব জানান আমার ওপরে নির্দেশ থাকার প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে দিচ্ছি। ওই কমিটির প্রধান করা হয় তিতাসের পরিচালক খান মঈনুল ইসলাম মোস্তাককে। কমিটিতে অন্য সদস্যরা হলেন, বোর্ডের আরেক পরিচালক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া এবং পেট্রোবাংলার জিএম জাবেদ পাটোয়ারি। কমিটি অনুসন্ধান শেষে তিতাসে ছয় সদস্যর একটি সিন্ডিকেট খুঁজে পায়। সিন্ডিকেটের সদস্য হলেন, ভালুকার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান ঝন্টু, গাজীপুরের ব্যবস্থাপক আ. ম. সাইফুল ইসলাম, ফতুল্লার ব্যবস্থাপক শহিরুল, চন্দ্রার উপ ব্যবস্থাপক তোরাব আলী, সিবিএ নেতা ফারুক হাসান। তদন্ত কমিটি মনে করছে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদুল ইসলাম। তদন্ত কমিটি এই সিন্ডিকেটের পরিচয় সম্পর্কে প্রতিবেদনে লিখেছেন, মশিউর রহমান ঝন্টু মিটার টেম্পারিংয়ের গুরু। তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌর বিএনপি নেতা মন্টুর ভাই জামাতপন্থি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মিটার টেম্পারিং করেই শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাস লাইন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটি বলছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্মকর্তা কর্মচারীদের তথ্যগত সহায়তা না করার নির্দেশ দেয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রকৃত দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা যায়নি। অধিকতর তদন্ত করলে আরও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে তিতাস রাজধানী আশপাশের এলাকায় প্রায় ১৭ লাখ বৈধ গ্রাহককে গ্যাস সরবরাহ করে। এই ১৭ লাখ গ্রহকের নিরাপত্তা এবং জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় মাত্র পাঁচটি জরুরী দল রয়েছে। প্রায় সবক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা ঘটার পর তিতাসের জরুরী দল পাইপ লাইন ঠিক করতে যায়। গ্রাহকরা দফায় দফায় তিতাসের সহায়তা চেয়েও পায় না। এতে মারাত্মক দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়। সম্প্রতি তিতাসের গাফিলতিতে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ বনানীতে তিতাসের গাফিলতিতে ছয়তলা ভবন গ্যাস বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে। ভবনের ৫০ জন বাসিন্দা প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছেন অন্তত ৭ জন। এরমধ্যে একজন অগ্নিদগ্ধ। ভবনটিকে সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বুয়েট। এই ঘটনায় তিতাসকে তিনদিন আগে থেকে ডেকেও পাশে পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। আর ঘটনার তিনঘণ্টা আগে থেকে দফায় দফায় ফোন করার পরও তিতাসের কেউ সাহায্যে এগিয়ে না এসে নিজেদের সমস্যা নিজেদের সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে। ঘটনা ঘটার অন্তত দেড়ঘণ্টা পর তিতাসের জরুরী দল আসে। আর পরের তিন শুক্রবার সকাল ৮টায় ওই পাইপ লাইন মেরামত করে তিতাসের জরুরী দল। কেন মাত্র পাঁচটি জরুরী দল জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন তারা তো কিছুই করতে চায় না। আমি গেলে সেøাগান দেয়া মানুষের তো অভাব দেখি না!
×