ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমরা জানি বাংলাদেশে কারা মুক্তিযোদ্ধা, কার কি ভূমিকা- প্রধান বিচারপতি;###;প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনলেও অন্য চার বিচারপতিকে কেনা সম্ভব নয় ॥ বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা;###;পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর আইনজীবী অনুমতি চাইলে সম্মানিত দুই মন্ত্রী

দেশে রায়ট হতো ॥ মীর কাশেম আলীর মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সিনহা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২১ মার্চ ২০১৬

দেশে রায়ট হতো ॥ মীর কাশেম আলীর মামলা থেকে নিজেকে  প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সিনহা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বলেছেন, ওই (মীর কাশেম) মামলা থেকে প্রধান বিচারপতি যদি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতেন তাহলে দেশে রায়ট (দাঙ্গা) হতো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বান্্চাল হয়ে যেত। তিনি আরও বলেন, দুই মন্ত্রীর বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তাদের বক্তব্যে তারা সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করেছেন। মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার, এই শপথ ভঙ্গ করলে পরিণতি কি হবে? তারা প্রধান বিচারপতিকেই ছোট করেননি গোটা বিচার বিভাগকে স্ক্যান্ডালাইজ করেছেন? প্রধান বিচারপতি যদি আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাহলে লাখ লাখ মামলার কি হবে। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নেপালের হাইকমিশনের মাধ্যমে ফোনে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি মন্ত্রীকে বলেছি কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে। একইসঙ্গে আমি দেশে ফেরার আগে দুই মন্ত্রীকে প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা চাইতে বলেছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীকে বকাঝকা দিয়েছে। এ বকাঝকায় কিছু হবে না। রবিবার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার শুনানিতে তিনি এ সমস্ত কথা বলেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক সকালে আদালতে হাজির হন। পরে অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে শুনানি আগামী ২৭ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি শুনানিতে বলেন, প্রধান বিচারপতি-বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ এগুলো ফৌজদারি আদালত অবমাননা। ডাকাতি মামলার আসামির যে রকম ফৌজদারি অপরাধ এটাও একই অপরাধ। জনকণ্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি। মন্ত্রী হিসেবে টকশো’য় যাবেন বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচনা করবেন। আপনি স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন কি হবে? টকশোতে যাবেন বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। সংবিধানের ১৪৮ ধারা পড়েন। আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এর পরিণতি কি হবে। আমরা ইচ্ছা করে রাত দশটা পর্যন্ত মিটিং করেছি। পরের দিন মামলার রায় দিয়েছি। মন্ত্রী বলে গেলেন, তখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরের দিন নিয়েছি। আমরা যে মেসেজ দিয়েছি। আপনার মক্কেল বুঝেছেন কিনা। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নেপালের হাইকমিশনের মোবাইল ফোনে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি মন্ত্রীকে বলেছি কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে। এরপরেও না হলে আপনার সরকারের কেবিনেট কি রকম চলছে। একইসঙ্গে আমি দেশে ফেরার আগে দুই মন্ত্রীকে প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা চাইতে বলেছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীকে বকাঝকা দিয়েছে। এ বকাঝকায় কিছু হবে না। পরের দিন ক্ষমা না চাইলে পরিণতি সাংঘাতিক খারাপ। বিমানবন্দর থেকে আমি বাসায় না গিয়ে সরাসরি কোর্টে আসি। এর পরের দিন গুরুত্বপূর্ণ রায় দেব। এর আগে এর চুল পরিমাণ বরখেলাপ হবে না। নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলেছি। মন্ত্রী আসলেন। বিচারকরা কথা বললেন না। এই কোর্ট সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি গোটা বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে পৃষ্ট করে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনলেও অন্য চার বিচারপতিকে কেনা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি একা কোন রায় দেন না। শুনানিতে দুই মন্ত্রীর উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন, এই আদালত যেকোন আদেশ দিতে দ্বিধাবোধ করবে না। এই কোর্ট সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। তাই সংবিধান ও আদালতের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। বিচারপতি ওয়াহ্্হাব মিয়া বলেন, প্রধান বিচারপতি চাইলেও তার পক্ষে একা রায় দেয়া সম্ভব না। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনলেও অন্য চার বিচারপতিকে কেনা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি একা কোন রায় দেন না। প্রধান বিচারপতি ও আমরা জনকণ্ঠের রায়ে বলে দিয়েছি। প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করে বলেন, মন্ত্রীকে প্রশ্ন করি। আপনি কাশেমের রায় পড়েছেন। কিন্তু ওনারা জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন? কাশেমের রায়কে প্রভাবিত করতে মন্তব্য করেছেন আমার সন্দেহ হয়। প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে স্ক্যান্ডালাইজ করেছেন? প্রধান বিচারপতি যদি আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাহলে লাখ লাখ মামলার কী হবে। শুনানির সময় দুই মন্ত্রী প্রায় ৫ মিনিট আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন দুই মন্ত্রীর আইনজীবীদের অনুরোধে আদালতের অনুমতি নিয়ে তাদের বসতে বলা হয়। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মোজাম্মেল হকের বসার অনুমতি চান। পরে প্রধান বিচারপতি বসার অনুমতি দিয়েছেন। সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বাসেত মজুমদার বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন মন্তব্য করব না বলে অঙ্গীকার করছি এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। প্রধান বিচারপতি আপীল বিভাগের প্রতি আমার সম্মান আছে। আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। আবেগপ্রবণ হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তাদের বক্তব্যে তারা সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করেছেন। তিনি বলেন, মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার, এই শপথ ভঙ্গ করলে পরিণতি কী হবে? একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের উদ্দেশে বলেন, আপনার মক্কেল যে জবাব দাখিল করেছেন, সেখানে আদালত অবমানার দোষ স্বীকার করেছেন। যেহেতু আপনি অবমাননার দোষ স্বীকার করেছেন, সেহেতু আপনার পরিণতি কী হবে? সেটির ব্যাখ্যা দিন। আদালত কামরুল ইসলামের আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারকে বলেন, আপনার ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা রিজেক্ট করলাম। পড়া লেখা করে আসেন। আপনার প্যারা ৫ সাংঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ। ব্যারিস্টার রফিক উল হককে বিচারপতি বলেন, আপনি জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোন বাধ্যবাধকতা আছে কিনা। বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ এগুলো ফৌজদারি আদালত অবমাননা। ডাকাতি মামলার আসামির যে রকম ফৌজদারি অপরাধ এটাও তেমনই। জনকন্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি। মন্ত্রী হিসেবে টকশোয় যাবেন বিচার বিভাগ নিয়ে সমালোচনা করবেন। আপনি স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন কি হবে? প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, দেশ চালাতে হলে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে কারা মুক্তিযোদ্ধা। কার কি ভূমিকা। আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতই ক্ষমতারধর হন না কেন আইন সোজা চলে। আঁকা বাঁকা পথে চলে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোন আদেশ দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না। আপনি যেই হোন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আদালতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও খাদ্যমন্ত্রীর পক্ষে আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার শুনানিতে অংশ নেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এসএম আবুল হোসেন ও সৈয়দ মামুন মাহবুব। এর আগে সকাল পৌনে ৯টার দিকে দুই মন্ত্রী তাদের বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সুপ্রীমকোর্টে হাজির হন। সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৭ সদস্যবিশিষ্ট আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এজলাসে উঠেন। আদেশ দেয়ার পর আবার ৯টা ৪২ মিনিটে এজলাস ত্যাগ করেন। প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের জেরে আদালত অবমাননার অভিযোগে জারি করা রুলের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে গত সোমবার আবেদন করেছেন দুই মন্ত্রী। তার পরের দিন মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সুপ্রীমকোর্টে হাজির হন। ওই দিন খাদ্যমন্ত্রী হাজির না হওয়ার ২০ মার্চ পূর্ণ শুনানির দিন ঠিক করেন আদালত। এর আগে জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর আপীলের রায় নিয়ে গত ৫ মার্চ প্রধান বিচারপতিকে জড়িয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন দুইমন্ত্রী। এতে ৮ মার্চ আপীল বিভাগ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হককে তলব করেন। একই সঙ্গে আদালত অবমাননার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না তার ব্যাখ্যাও জানতে চাওয়া হয়। ১৫ মার্চ তাদের আদালতে হাজির হওয়ার দিন ধার্য ছিল। ওই দিন সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ মার্চ আবারও তারিখ ঠিক করা হয়। রবিবারও দুই মন্ত্রী হাজির হয়েছিলেন আদালতে কিন্তু তাদের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় আবারও হাজির হয়ে কারণ ব্যাখ্যার জন্য বলেছেন। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি শপথ নিয়েছেন। আপনার স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের অপরাধ এক কিনা। দোষ স্বীকার করার পর কী হতে পারে। একজন অপরাধীকে যখন ডেকে এনে বলা হয়-তুমি দোষী না নির্দোষ। দোষ স্বীকার করছি ক্ষমা করেন। তখন কোর্ট কি করে? কোর্ট কি করবে? ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, সিম্পল পানিশমেন্ট দিতে পারে। আমি তো অন্যায় করেছি মাফ চেয়েছি। এ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, মার্সি যখন চাই তখন কোন দোষ স্বীকার করে চাই। আমরা ক্ষমা চেয়েছি। পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে। বিচারপতি ওয়াহ্্হাব মিয়া বলেন, আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে কারা মুক্তিযোদ্ধা। কার কি ভূমিকা। এ সময় আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, আমরা যথাযথভাবে আবেদন দিব। সময় চাই। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতই ক্ষমতা ধর হন না কেন আইন সোজা চলে। আঁকা বাঁকা পথে চলে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোন আদেশ দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না। আপনি যেই হোন। বাসেত মজুমদার বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন মন্তব্য করব না বলে অঙ্গীকার করছি। এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। প্রধান বিচারপতি আপীল বিভাগের প্রতি আমার সম্মান আছে। আবেদনকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা। আবেগ প্রবণ হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
×