ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বড় ডাক্তারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন তিনি

মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়াই যার ব্রত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়াই যার ব্রত

সমুদ্র হক ॥ ডাক্তারি পড়ার সময়ই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ডাক্তারি পাস করেই মনস্থির করেন, যতদিন পৃথিবীতে থাকবেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা তো দেবেনই নিজে না পারলে বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথঘাট ঠিক করে দেবেন। দরকার হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসা করার জন্য অনুরোধ করবেন। দীর্ঘদিন ধরে নীরবে নিভৃতে এই সেবা দিচ্ছেন প্রচার বিমুখ একজন চিকিৎসক আরশাদ সায়ীদ। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। ভারতের তরঙ্গপুরে সাত নম্বর সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক (সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত) মেধাবী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং দেন। প্রবাসী সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিবন্ধন করার নির্দেশ দিলে ওই ক্যাম্পের প্রথম তিনজনের মধ্যে তার নাম ডাঃ আরশাদ সায়ীদ সিরিয়ালের দ্বিতীয় স্থানেই থাকে। তারপর তার মর্যাদার জায়গাটিতে আঘাত করা হয়েছে। এই অভিমানে তিনি ব্যথিত। তবে মুক্তিযোদ্ধার কমিটমেন্ট থেকে এতটুকুও বিচ্যুত হননি। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় কোন বিঘœ ঘটাননি। বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সেবার মান আরও বাড়িয়েছেন। বললেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুর পর গান স্যালুট পাচ্ছে। একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বর্তমানে তাদের যা বয়স তাতে বার্ধক্যজনিত রোগের সঙ্গে হৃদরোগ ডায়াবেটিস ও রক্তচাপেই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এই মুক্তিযোদ্ধারা যখন চিকিৎসা সেবা নিতে যান তখন অনেক চিকিৎসক তাদের বীরত্বগাথা অধ্যায়কে স্মরণ করেন না। অনেক ক্ষেত্রেই সেবার মান ভালও থাকে না। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাতা দেন তাতে যতটা সম্ভব সংসার চালিয়ে নেন। মুক্তিযোদ্ধারা করুণা চয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা যে বিজয় এনে দিয়েছে এই সম্মানটুকুই তারা চায়। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ বিজয়ী যোদ্ধা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের শেষ অধ্যায়ে নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটা পারছেন সেবা দিচ্ছেন। ১৯৭১ সালে আরশাদ সায়ীদ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ট্রেনিং গ্রহণের সময় তরঙ্গপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক দুজন মেধাবী মেডিক্যাল শিক্ষার্থী পেয়ে তাদের ভালভাবে গড়ে তোলেন। অপরজন হলেন একই মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব ওয়ালেস (বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী)। নিবন্ধনের খাতায় প্রথম এই দুজনের নাম থাকার টাইপ করা কপিটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে থাকার পরও ডাঃ আরশাদের নাম এত দিনেও লিপিবদ্ধ হয়নি। ডাঃ আরশাদ অভিমান করে বলেন মক্তিযুদ্ধ করেও তার নাম লিপিবদ্ধ না হওয়ার কারণে তিনি গান স্যালুট হয়ত পাবেন না তবে যে ব্রত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাতে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে তিনি নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড় পুরস্কার পাবেন। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ দেশ স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের পরই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হতে ১৯৭৬ সালে এমবিবিএস পাস করার পর কিছুদিন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় লিবিয়িায় চাকরি নিয়ে যান। সেখানে তার চোখ মুখ আরও খুলে যায়। দেখেন ওই দেশের হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশের পর কি সম্মান পান। ডাক্তাররা তাদের কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে সর্বোচ্চ বিশেষ সেবা দেন। বছর কয়েক থেকে দেশে ফিরেই তিনি এমন সেবার একটা প্রতিষ্ঠান গড়েন। তার চিকিৎসাবিদ্যার মধ্যে যতটা কুলায় সেবা দিয়ে বড় ধরনের রোগ বাঁধলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেন। বর্তমানে তিনি বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের একটি কক্ষকে মুক্তিযোদ্ধা স্বাস্থ্য সেবা বানিয়েছেন। সেখানে নিয়মিত বসে প্রতিদিন ১০/১৫ জন করে মুক্তিযোদ্ধা রোগী দেখেন। বললেন একটি ইলেকট্রো কার্ডিওগ্রাম মেশিন থাকলে ভাল হতো। লাল রঙে মুক্তিযোদ্ধা স্বাস্থ্যসেবা লিখিত প্যাডে প্রেসক্রিপশন করে জটিল রোগ হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে ওই প্যাডেই রেফার করে রোগীকে ভালভাবে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। কখনও নিজে রোগীকে নিয়ে যান। তার সাধ্যের মধ্যে যতটা পারেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। স্ত্রী রুবা ও দুই সন্তান এই কাজে গর্ববোধ করে। স্ত্রী রুবার কথা; দেশে হয়ত অনেক চিকিৎসক মুক্তিযোদ্ধা আছেন তারা কতটা কী করেন তা জানা নেই তবে ডাঃ আরশাদ সায়ীদ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তা দেখে গর্ববোধ করেন। সন্তানদেরও তারা এই শিক্ষাতেই লালন করেছেন। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল তার স্কুলের (বগুড়া জিলা স্কুল) সহপাঠী। দুই বন্ধুই বিদেশের মোহ ত্যাগ করে দেশে থেকেই যে যার অবস্থানে কাজ করে যাচ্ছেন। ডাঃ সায়ীদ বললেন এবারের বইমেলায় তার লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘আমার অনেক ঋণ আছে।’ নিজের কথাও তাই- এই দেশ তাকে অনেক দিয়েছে। দেশের জন্য তার ঋণ শোধ করার পালা। নাই বা মিলল গান স্যালুট। তিনি তো মুক্তিযোদ্ধাদের স্যালুুট করছেন...।
×