ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইয়ুব রানা

অভিমত ॥ একটি অন্যতম ‘মুক্তাঞ্চল’

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২০ মার্চ ২০১৬

অভিমত ॥ একটি অন্যতম ‘মুক্তাঞ্চল’

২৬ থেকে ২৮ মার্চ মৌলভীবাজার জেলায় পাকবাহিনী আক্রমণ করে। আতঙ্কিত মানুষজন পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে ছুটতে থাকে। মৌলভীবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা মীর্জা আজিজ আহমেদ বেগ মুক্তিকামী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহরের চেকপোস্ট চাতালাপুর স্থলবন্দরের দিকে এগুতে থাকেন। এই স্থলবন্দর এলাকার চেকপোস্টে তখন দুটি টিনের ছাউনি এবং টিনের বেড়া দেয়া অফিস ঘর ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে বেগ সাহেব একটি পোর্টেবল মাইক দিয়ে ভারতের দিকে মুখ করে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকসেনাদের আক্রমণের কথা বলে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, ‘ওপারে কেউ কি নেই আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করে?’ ভারতীয় অংশের রাধা কিশোর ইনস্টিটিউশনের মাঠে দাঁড়িয়ে এসব পর্যবেক্ষণ করছিল কৈলাসহর ছাত্র আন্দোলনের সৈনিক ২২ বছরের এক টগবগে তরুণ। সে এগিয়ে এসে বললো ‘আমি আছি’। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতেই বেগ সাহেব বুকে জড়িয়ে ধরলেন সেই যুবককে। সেইসঙ্গে হাতের পোর্টেবল মাইকটি তুলে দিলেন সেই যুবকের হাতে। যুবকটি তখন মাইকে নিজের সমর্থন জানিয়ে সকলকে আহ্বান জানালেন এপারে (ভারতের দিকে) নিরাপদ আশ্রয়ে আসার জন্য। যুবকটির নাম মোহিত পাল। আদি বাড়ি পূর্ব পাকিস্তানের শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জে। কৈলাসহরে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছেন। রামকৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। ত্রিপুরার বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত। মোহিত বেগ সাহেবকে নিয়ে গেলেন কৈলাসহর মহকুমা শাসকের কাছে। মহকুমা শাসক অবাঙালী আইএএস অফিসার নাম গঙ্গাদাস। তিনি বললেন, এখনও সরকারী কোন নির্দেশ আসেনি শরণার্থীদের বিষয়ে, তবে যারা আসে সকলের তালিকা তৈরি করে রাখবেন। মহকুমা শাসক গঙ্গাদাস মহাশয়ের সঙ্গে মোহিত পালের সুসম্পর্ক ছিল। তিনি পরামর্শ দিলেন ভারতে একটি সংগ্রাম সমর্থক বাহিনী নাম দিয়ে সংগঠন তৈরি করে কাজ করার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে পরামর্শ অনুযায়ী সংগ্রাম সমর্থক বাহিনীর নামে একটি রাবার স্ট্যাম্প তৈরিপূর্বক তালিকা তৈরি করে কাজ শুরু করে দেয়া হলো। কৈলাসহর থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি ছিলেন পরাগ দত্ত, তিনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রথমে বেসরকারীভাবে যারা আসছে তাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। সেইসঙ্গে মুক্তিবাহিনী গড়ার প্রস্তাব আসতেই বেগ সাহেব এবং মোহিত, গফুর মিলে তালিকা তৈরি শুরু করলেন। ইতোমধ্যে ভারত সরকারের পক্ষে ত্রিপুরার প্রতিটি তারবার্তা এলো শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য। ’৭১-এ ত্রিপুরা ছিল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, তাই সরাসরি কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসত। শুরু হলো সীমান্ত এলাকাগুলোতে শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি। শরণার্থীদের জন্য রেশনকার্ড তৈরি হলো। ভারত সরকার তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিলেন। কলেজের ছাত্ররা যারা এনসিসি করত তাদের থেকে শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করার জন্য অস্থায়ীভাবে কর্মী নিয়োগ করা হলো। এরপর শরণার্থীদের সমস্ত ভার নিলেন ভারত সরকার। যাদের আত্মীয়স্বজন আছে তারা শরণার্থী ক্যাম্পে গেলেন না। আবার যাদের নিজস্ব অর্থের অভাব ছিল না তারা নিজেরা ঘর ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করলেন। এমন সময় সংবাদ এলো পাকবাহিনী শমসেরনগর আক্রমণ করতে পারে। যে সকল যুবক মুক্তিবাহিনী হিসেবে কাজ করতে চায় তাদের নিয়েই একটা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়া হলো। স্থানীয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষও সজাগ, যাতে মনু নদী পার হয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা চাতলাপুর না আসতে পারে। ২৭ মার্চের ঘটনা। হঠাৎ দেখা গেল পশ্চিম দিকে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান। একটু পরেই মৌলভীবাজারে পাকবাহিনী শেলিং শুরু করছে। বেশকিছু হতাহতের সংবাদও পাওয়া গেল। মোহিত, গফুরসহ এক বিরাট বাহিনী শরণার্থীদের নিরাপদে ভারতে প্রবেশের সব ব্যবস্থা করলেন। ভারতে যেসব যুবক মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের সঙ্গে যোগ দিল কিছু ইপিআর। আগে থেকেই ইপিআর থেকে এক কোম্পানি জওয়ান যারা মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করতে আসে তাদের নিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ এবং ভারতে সংগঠিত যুবকরা মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সুবেদার সামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআররা সেদিন প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা নেন। সেদিন শমসেরনগরে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১ কোম্পানি ইপিআর ও দুই শতাধিক জনতা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এটাই ছিল সিলেটের সশস্ত্র প্রতিরোধ। সন্ধ্যায় আবার চাতলাপুর চেকপোস্টের অস্থায়ী ক্যাম্পে বৈঠক বসে মুক্তিবাহিনীতে যারা নাম লিখিয়েছে তাদের নিয়ে। সেখানে ছিলেন আজিজ বেগ, ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা মোহিত, গফুর। পরদিন ২৮ মার্চ আবার শমসেরনগর বাজারে আক্রমণ করে পাক হানাদার বাহিনী। এর মধ্যে শমসেরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর আহমেদ, সাজ্জাদুর রহমান, আমজাদ আলী প্রমুখ এক গোপন সভা করে সীমান্ত ফাঁড়িগুলোর সকল ইপিআরকে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। ভোরের আলো ফোটার আগেই হাজার হাজার জনতা শমসেরনগর বাজারে জড়ো হয়। এমন সময় মৌলভীবাজারের দিক থেকে ৩টি সামরিক গাড়ি করে পাকসেনারা আসে। শমসেরনগর রেল স্টেশনের কাছে একটি মালগাড়ির পরিত্যক্ত কামড়া থেকে পাকসেনারা জনতার দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। ওরা ভেবেছিল গুলি ছুড়লেই জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাবে। কিন্তু সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা শমসেরনগর আমানউল্লাহর বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে এবং নিচে একটি মিষ্টির দোকানের দেয়ালের আড়াল থেকে পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করে। মুহূর্তে এক পাকসেনা লুটিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে আরও একজন আহত হয়ে কাতরাতে থাকে। চারদিক থেকে দেশী অস্ত্র নিয়ে হাজার হাজার জনতা চিৎকার করে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন পাকসেনারা শমসেরনগর বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়; কিন্তু বিমান ঘাঁটি দখল করতে পারেনি। কৈলাসহর থেকে বেশকিছু বিএসএফ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানে গেলেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িক কৌশল হিসেবে শেরপুর থেকে পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসেন মৌলভীবাজারে। মৌলভীবাজারে সেদিন মোহিত, আজিজ বেগ এবং অন্য ছাত্রনেতারা কৈলাসহর থেকে বেশ কিছু শুকনো খাবার এবং ওষুধপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর সঙ্গে সেই ভারতীয় যুবক মোহিতের দেখা শেরপুর থেকে ফিরে আসার পথে মৌলভীবাজারে। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী মোহিতকে আগে থেকেই চিনতেন। তাই মোহিতের সঙ্গে পরামর্শ করে মানিক চৌধুরী ঠিক করলেন কৈলাসহরেই আশ্রয় নেবেন। কৈলাসহরে একই রাতে গিয়ে আত্মগোপন করেন এমএনএ গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, মৌলভীবাজারের ঠিকাদার সোলেমান হুসেন প্রমুখ। জেল থেকে বেরিয়ে আসেন এমপি আজিজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মহসিন আলী (সদ্য প্রয়াত), মুছব্বির আলী (সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান), মুজিবর রহমান মুজিব (ছাত্রনেতা)সহ অনেক নেতাই এসে আশ্রয় নেন। ততদিনে ভারতের সরকারী সহায়তাও পুরোদমে পেতে শুরু করেছে মুক্তিবাহিনী। প্রতিদিনই মানুষ মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে শুরু করে। ভারতে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সেই নির্ভীক যুবক গফুর প্রাথমিকভাবে সংগঠিত হওয়া মুক্তিবাহিনী নিয়ে বহু আক্রমণ সংগঠিত করে। আলীনগর ইপিআর ক্যাম্প দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঙ্গী ছিল ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা মোহিত। গফুরের এই আক্রমণের সংবাদ পাকসেনাদের কাছেও ছিল। তাই একদিন গফুরের বাবা, চাচাসহ একই বাড়ির চারজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকসেনারা। তাদের বেয়নেট দিয়ে আহত করে জ্যান্ত কবর দেয় পৃথি¦মপাশা বৃন্দা দীঘির পাড়ে। এরপর গফুর তার মাকে বাড়ি থেকে এক গভীর রাতে মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে কৈলাসহর নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে রাজাকার বাহিনী আক্রমণ করলে কৌশলে দুই বন্ধু সব রাজাকারকে খতম করতে সক্ষম হয়। নিদর্শন হিসেবে রাজাকারদের একটি করে কান কেটে নিয়ে যায় ওরা। এই ‘কান কাটার বাহিনী’ সীমান্ত এলাকার মানুষের মুখে মুখে রূপকথার কাহিনীর মতো ছিল সেই সময়। এরা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় কিভাবে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয় সেই ইতিহাসও সকলেরই জানা। ১৬ ডিসেম্বরের আগে ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মুক্ত হয়। সেদিন মৌলভীবাজার থানা অফিসের দায়িত্বে থাকা মীর্জা আজিজ বেগ মোহিতকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর সেই ভারতীয় ছাত্র আবার ভারতে চলে যান পড়াশোনা শেষ করে এদেশে পিতৃপুরুষের ভিটেতে ফিরবেন বলে। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী বহুবার মোহিতকে হবিগঞ্জে এসে বিশেষ দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেন। কিন্তু মোহিতের আর আসা হলো না, ভারতেই কাজে যোগ দিলেন সাংবাদিকতায়। তার লেখা বইও প্রকাশ হয়েছে ২০০৯ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট পশ্চাদভূমি কৈলাসহর’। বর্তমানে তিনি ‘ভারত-বাংলা মৈত্রী উৎসব’-এর আহ্বায়ক হিসেবে ত্রিপুরায় উনকোটি জেলায় কর্মরত। বিশ্বের প্রথম বাঙালী ভূপর্যটক হবিগঞ্জের রামনাথ বিশ্বাসের নামে যে ফাউন্ডেশন আছে সেই ‘রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশন’-এর একজন সম্মানিত সদস্য। বর্তমানে উনকোটি জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহিত। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আমার কথা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক মোহিত চাতলাপুর চেকপোস্টের টিনের ঘরটি দেখিয়ে বললেন, এই জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটি তীর্থস্থান। এই ঘরটিতে বসেই বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চাতলাপুর চেকপোস্টের সামনেই ভারতীয় অংশে রাধা কিশোর ইনস্টিটিউশনের খেলার মাঠ। এই মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আর্টিলারী বাহিনী দুটি কামান নিয়ে প্রস্তুত ছিল। চাতলাপুর স্থলবন্দরসহ মনু নদীর পশ্চিম দিকের পুরো মৌজা এলাকা ছিল শুরু থেকেই ’৭১-এর অন্যতম ‘মুক্তাঞ্চল’। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান।
×