ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের বর্ষীয়ান বামপন্থী রাজনীতিক বিমান বসুর মন্তব্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাইরের কেউ করে দেয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৬ মার্চ ২০১৬

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাইরের কেউ করে দেয়নি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) পলিটব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাইরের কেউ করে দেয়নি। মূলত ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই স্বাধীনতার সলতে পাকানো শুরু হয়, যা একাত্তরে জ্বলে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, শৌর্যবীর্য এবং গৌরবগাথা বাইরে থেকে কেউ তৈরি করে দেয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষেরাই নিজেদের পথ বেছে নেয়ার জন্য এই আন্দোলন-সংগ্রামে নেমেছিলেন। শনিবার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এ সভার আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী বিমান বসু বলেন, বিভিন্ন ভাষ্যকারের লেখা বাংলা, হিন্দি, ইংরেজী ম্যাগাজিন আমি পড়েছি। সেসব লেখা পড়ে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম বোধহয় বাইরে থেকে সংগঠিত হয়েছে! এটা বললে ইতিহাসের বিকৃতি হবে। পৃথিবীতে যতগুলো মুক্তি সংগ্রাম হয়েছে; কোন একটা মুক্তি সংগ্রাম বাইরে থেকে সম্পন্ন হয়নি। ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করেছে, কিন্তু সেদেশের মানুষ আত্মত্যাগ না করলে সে সংগ্রাম সফল হতো না। ভারতের বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যদি আরও আগে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি আরও কমানো যেত। এ প্রসঙ্গে তিনি সত্তরের দশকে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিক ময়নিহানের লেখা ‘এ ডেঞ্জাজারস প্লেস’ বইটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ও ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা মূল্যায়নের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চেই ভারতের বামপন্থীরা সরকারের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার এ দাবির যথার্থ মূল্যায়নে দেরি করে। সেদিন ভারতের বামপন্থীদের দাবি ইন্দিরা গান্ধীর সরকার মেনে নিলে এক কোটি শরণার্থীকে হয়ত ভারতে যেতে হতো না। শরণার্থীদের জন্য ত্রাণের অর্থ সংগ্রহের স্মৃতিচারণ করে প্রবীণ এই বামপন্থী নেতা বলেন, ২১ সদস্যের ‘বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটি’ গঠিত হয়েছিল,। আমি ওই কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। ওই সময় যে পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল, আমার জীবনে আগে-পরে আর কোন ক্ষেত্রে তা হতে দেখিনি। দুই দেশে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। বিমান বসু বলেন, আপনাদের এখানে বর্ণ, জাতি ভিত্তিতে বিভাজন এত প্রকট না, হয়ত ইস্যুই না। ভারতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন প্রকট। দুই দেশের সম্পর্ক ব্যাপারে বামপন্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যে শক্তি ভারতের জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করছে, সেই শক্তিই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, বিভাজন ও বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা তাদের সমর্থকদের পানি দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে তৎপর। বাংলাদেশ যে অগ্রগতি ও শান্তির পথে হাঁটছে, সেই পথে তারা ফাটল তৈরির চেষ্টা করতে পারে। তাই দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এই পক্ষের চক্রান্তের জাল সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থে ভারত ও বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর নিজ নিজ দেশে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন। একই সভায় সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ত্রিপুরার রাজনীতিক গৌতম দাস বলেন, সিপিআইএম ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দেয়। তিনি বলেন, একাত্তরে ত্রিপুরার জনসংখ্যার দ্বিগুণ বাংলাদেশী শরণার্থী সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ত্রিপুরার বামপন্থী নেতা নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সিপিআইএমের নেতাকর্মীরা শরণার্থীদের জন্য শিবির খোলা, ওষুধ, খাবার ও কাপড়ের ব্যবস্থা করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থের ব্যবস্থা করে। তিনি একাত্তরের নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধে সিপিআইএমের বিভিন্ন রাজনৈতিক ভূমিকার তথ্যবহুল বয়ান তুলে ধরেন। আলোচনা সভার সভাপতি ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের বামপন্থীদের মূল্যায়নের প্রয়োজন। মস্কো-পিকিংপন্থী নির্বিশেষে ভারতের সব ক’টি বামপন্থী দলই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান আড়ালে চলে যাচ্ছে। যুদ্ধে প্রথম যে সহায়তা; সেই ত্রিপুরার সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেয়া হয়েছিল ভারতের বামপন্থীদের আন্দোলনের কারণেই। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ভারতের বামপন্থীদের সহযোগিতার বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। মেনন বলেন, বামপন্থীদের পাশাপাশি ভারতের জনগণের সম্মিলিত সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়েছে। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
×