ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আগের কোন উদ্যোগে প্রত্যাশিত ফল মেলেনি

কর্মস্থলে ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবার ভিডিও কনফারেন্স

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২ মার্চ ২০১৬

কর্মস্থলে  ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবার ভিডিও কনফারেন্স

নিখিল মানখিন ॥ একের পর এক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি প্রত্যাশিত হারে আনতে পারছে না সরকার। এবার তাৎক্ষণিকভাবে দেশের যে কোন সরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম স্বয়ং টেলি কনফারেন্সে অংশ নেবেন। এর আগে কর্মস্থলে সরকারী চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে টেলিফোনে মনিটরিং ও সরেজমিন পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে টেলিফোনে তাদের অবস্থান সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও প্রতি দু’মাসে একবার নির্ধারিত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন ও প্রতিবেদন দাখিল করার উদ্যোগও নেয়া হয় । বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার ক্ষেত্রেও মনিটরিং ও সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে পারফর্ম্যান্স পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ‘বৈদ্যুতিক হাজিরা মনিটরিং ব্যবস্থা’ চালু করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু ওসব উদ্যোগ গ্রহণ করেও কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি সন্তোষজনক হারে নিয়ে আসা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত মনিটরিং সেলের এক বৈঠকে চিকিৎসকের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেলের কর্মকর্তাদের শৈথিল্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি যে কোন উপায়ে ডাক্তারদের স্ব স্ব কর্মস্থলে হাজিরা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। বৈঠকে ছয় মাসের মনিটরিং প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সার্ভিসেস (এমআইএস) প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন-২০১৪ অনুসারে দেশে বর্তমানে সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা ২১ হাজার ৫৫৩। তাদের মধ্যে ১৫ হাজার ১৯২ পুরুষ ও ছয় হাজার ৩৬১ নারী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কর্মস্থলে চিকিৎসকের উপস্থিতি তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির ফলে সাধারণ রোগী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিনা অনুমতিতে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে তারা বিব্রত হচ্ছেন। তারা জানান, গত ছয় বছরে এ্যাডহক ও বিসিএসের মাধ্যমে ৭-৮ হাজার নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক সময় চিকিৎসক সঙ্কটের দোহাই দেয়া হলেও এখন আর তা বলার সুযোগ নেই। কর্মস্থলে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলেই সাধারণ মানুষের নাগালে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে শৈথিল্যের বিষয়টি উঠে আসে । ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেশিরভাগ কর্মকর্তা টেলিফোনে চিকিৎসকের উপস্থিতি পরিবীক্ষণ করছেন না, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শনও করছেন না। ফলে মনিটরিং সেলের কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিবিড় ও ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা আবশ্যক এবং পরিবীক্ষণের পর সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে ওই চিঠিতে জানানো হয়। এদিকে, স্বাস্থ্য সেক্টরের সরকারী চিকিৎসক ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হয়ে আসছে। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকদের কেউ কেউ কর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর দিয়েই চলে যান। অনেকে আসেন দিনের শেষ বেলায়। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসকদের দেখা পায় না রোগীরা। তবে নিজেদের আবাসিক কক্ষে গড়ে তোলা অবৈধ চেম্বারে অফিস সময়ে চড়া ফি নিয়ে রোগী দেখতে ভুলেন না চিকিৎসকরা। আর এ্যাডহক চিকিৎসকের বিরাট অংশ নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক স্বয়ং দেশের প্রায় ৬ হাজার চিকিৎসককে কর্মস্থলে না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন । বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও এ ব্যাপারে বার বার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এমনকি চাকরিচ্যুত করার মতো কঠিন শাস্তি দেয়ার হুমকিও দিয়ে আসছেন। কিন্তু কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত পরিদর্শন টিমের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। থানা পর্যায়ে টিমের সদস্যরা যান না। সরকারী চিকিৎসাসেবা এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হকের আমলে সরকারী চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। গত বছর কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ‘বৈদ্যুতিক হাজিরা মনিটরিং ব্যবস্থা’ চালু করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরাধীন অনেক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয় বায়োমেট্রিক যন্ত্র। স্বাস্থ্য অধিদফতর এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়েছে, কর্মস্থলে চিকিৎসকদের ইলেকট্রনিক হাজিরা মনিটরিং করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত মেশিনে চিকিৎসকদের ইলেক্ট্রনিক হাজিরা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘বায়োমেট্রিক মেশিন কোন সময় অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে বলে জানানো হয় পরিপত্রে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথমে দেশের কিছুসংখ্যক সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বায়োমেট্রিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। তখন চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থাপিত বায়োমেট্রিক মেশিন নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছিল খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত আদেশ পাঠানো হয়েছে সিভিল সার্জন এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের কাছে।
×