ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানী, যশোর ও গাজীপুরে অভিযান

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের ৮ সদস্য আটক, ৪ নারী উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১ মার্চ ২০১৬

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের ৮ সদস্য আটক, ৪ নারী উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আন্তর্জার্তিক মানবপাচারের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। রাজধানীসহ যশোর ও গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ৪ নারীকে। তাদের মধ্যে গাজীপুরের বড়বাড়ি থেকে রোকন (২১) ও আয়শা আক্তার (২৫), যশোরের বেনাপোল থেকে আমির (২২), হাসান খন্দকার (৩০), হাবীব (৩২), মিল্টন (২২), সামাদ (৩২) এবং ফকিরাপুল পানির ট্যাংক এলাকা থেকে মোঃ মামুন মির্জাকে (২৮) আটক করা হয়। এছাড়া যশোরের বেনাপোল থেকে সোহাগী ও শিরিনকে এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকা থেকে শারমীন ও রিয়াকে মানবপাচারকারী চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। সোমবার দুপুরে র‌্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ভারতে পাচার হওয়া নারীদের নগদ টাকার বিনিময়ে ফেরত পেতে একটি ফাঁদ পাতে র‌্যাব। এরই অংশ হিসেবে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বড়বাড়ি এলাকায় সোহাগীকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করার সময় রোকন ও আয়শা আক্তারকে আটক করা হয়। এরপর ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে রাজধানী ও বেনাপোল থেকে বাকি ৬ জনকে আটক করা হয়। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৪ নারীকে। কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, মানবপাচার চক্রের সদস্যরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিরীহ ও গরিব নারীদের ভাল চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে এনে পাচার করে দেয়। পরে তাদের দিয়ে জোর করে যৌনকর্ম করানো হয়। অনেক সময় কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের কাছেও তাদের বিক্রি করে দেয়া হয় নারীদের। র‌্যাবের অভিযানে অবৈধভাবে বিদেশে নারী পাচার ও জিম্মি করে নির্যাতনপূর্বক অর্থ আদায়ের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে ৪ জন ভিকটিম ও জাল ভিসা ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্বার করা হয়। এ মানবপাচারের নেপথ্য কাহিনী সম্পর্কে র‌্যাব জানায়- গত ১৭ আগস্ট আগস্ট টাঙ্গাইলের ঘাটাইল এলাকার রওশন আরার মেয়ে সাবিনা অপহৃত হন। এ সম্পর্কে একটি অভিযোগ করা হয় টাঙ্গাইল র‌্যাব অফিসে। সপ্তাহখানেক পর ২৫ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ফোন করে জানান সাবিনা ভারতে আছেন। ৫ লাখ টাকা পাঠালে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। এরপর র‌্যাব তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণকারীদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ইন্টারপোলের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগসহ ভিকটিমকে উদ্ধারে তৎপর হয়। এ অবস্থায় র‌্যাব-১২, টাঙ্গাইল ক্যাম্প ভিকটিমকে উদ্ধারের জন্য গৃহীত নানামুখী তৎপরতার এক পর্যায়ে গোপন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে ভারতে পাচার হওয়া ভিকটিমকে নগদ টাকার বিনিময়ে ফেরত আনার লক্ষ্যে ফাঁদ পাতে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দালাল চক্রের সক্রিয় সদস্য মোঃ রোকনকে গাজীপুর জেলার বড়বাড়ী এলাকা থেকে ১ জন তরুণী ভিকটিম সোহাগীকে পাচারকারী দলের অপর সদস্য আয়েশা আক্তার আশার নিকট ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করার সময় ভিকটিমকে উদ্ধারসহ ২ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিমকে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে বিক্রয়ের জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানাধীন ধলপুর এলাকার আমির ও হাসানের সঙ্গে ৮০ হাজার টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তরুণীকে বিক্রয়কালে আমির ও হাসান খন্দকারকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে অপর পাচারকারী তাহের পালিয়ে যায়। ধৃত হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই তরুণীকে বিক্রি ও ভারতে পাচারের পরিকল্পনা ছিল তাদের। সেই লক্ষ্যে তারা ভারতের কলকাতার গরিয়া নামক স্থানে অবস্থানরত কথিত দিদির নিকট ২ লাখ টাকা দাম নির্ধারণ করে। ভিকটিম সোহাগীকে ক্রয় করে তাকে সহ ও অপর ভিকটিম শিরীনকে যশোর জেলার বেনাপোলের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থানরত দিদির প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল। এদিকে র‌্যাব আটককৃত আসামিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে তাদের নিকট পাচারের উদ্দেশ্যে শিরীনকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন ধলপুর বউ বাজার এলাকার ১টি চারতলা বাড়ির ৩য় তলায় ২ বছর যাবৎ আটক রাখা আছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিরীনকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন ধলপুর বউ বাজারের ঐ বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে র‌্যাব-১২ এর একটি দল পাচারকারীর ছদ্মবেশে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে ভিকটিম সোহাগী ও শিরীনকে হস্তান্তরের জন্য ফাঁদ পাতে এবং বেনাপোল সীমান্তের সূর্যখালী এলাকা থেকে রবিবার গভীর রাতে হাবিব, মিল্টন ও সামাদ নামীয় পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। আটকের পর হাবিব, মিল্টন ও সামাদ স্বীকার করেন তারা ভারতে অবস্থানরত দিদির বাংলাদেশীয় প্রতিনিধি। অনুসন্ধানে আরও জানা যায় যে, দিদির নিকট যাদের পাচার করা হয় তাদেরঅবৈধ পথে সীমান্ত পার করে দিদির ভারতীয় প্রতিনিধি চন্দন ও দুঃখের নিকট হস্তান্তর করে থাকে। একই কৌশলে সোহাগী ও শিরীনকে গ্রহণ করে অবৈধ পথে সীমানা পার করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ধৃত ব্যক্তিদের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্টন থানাধীন ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি এলাকা থেকে মানব পাচারকারী চক্রের অপর সক্রিয় সদস্য মোঃ মামুন মির্জাকে (২৮) গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করে মামুনকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়। তখন সালমান নামে অপর পাচারকারী র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পলায়ন করে। তাদের নিকট পাচারের উদ্দেশ্যে ২ জন কিশোরী (শারমিন ১৫ দিন ও রিয়া ৩ মাস যাবত) আটক আছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকা থেকে ২ কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত কিশোরীরা জানান, তাদের ২ জনকে মামুন বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে ধারণকৃত ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে জোর পূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছে। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদ্বয় আরও জানান, মামুন তাদের ভারত হয়ে অন্য কোন দেশে পাচার করার পাঁয়তারা করছিল। গ্রেফতারকৃতদের নিকট হতে ১২টি পাসপোর্ট, ১১টি ভিসা, ৫১টি বিমানের জাল টিকিট এবং ৫৩টি বিদেশে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র, ১টি ভিডিও ক্যামেরা ও ১৪টি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়।
×