ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মজীবনী গ্রন্থ আইএ শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় প্রথম প্রেমপত্র পাই ॥ এরশাদ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আত্মজীবনী গ্রন্থ আইএ শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় প্রথম প্রেমপত্র পাই ॥ এরশাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘রংপুরের কারমাইকেল কলেজে আইএ শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় প্রথম প্রেমপত্র পাই। চিঠিটি হাতে পাবার পর চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল। এখন কি হবে। কোথায় চিঠিটি দেখব। কলেজের একটি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর খোলা হলো চিঠিটি। চিঠির ভাঁজে ভাঁজে দেয়া ছিল গোলাপ ফুলের পাপড়ি। চিঠিতে লেখা ছিল- ভুলোনা আমায়-মনে রেখো। ভাতের আঠা দিয়ে লাগানো ছিল চিঠির খাম। যে মেয়েটি প্রেমপত্রটি দিয়েছিল সে কলেজে আসত ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে। তাই সব সময় তাকে পাওয়া যেত না। কথা বলার সুযোগও কম ছিল। চিঠি পাবার পর থেকে মাঝে মাঝে দু’একটি কথা হতো তার সঙ্গে...। নিজের লেখা ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এভাবেই জীবনের প্রথম প্রেমের কথা লিখেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জন্মের পর বাবা আদর করে যার নাম রেখেছিলেন ‘এরশাদ’ ওরফে ‘পেয়ারা’। গ্রন্থের ৬৮ পৃষ্ঠায় আছে ‘আমার বিয়ে’ শিরোনামে আরেকটি অধ্যায়। যেখানে বিদিশার সঙ্গে বিয়ের কোন বিষয় উল্লেখ নেই। পুরোটাই রওশনকে নিয়ে লেখা। এ পর্বে এরশাদ লিখেছেন, এমএ পরীক্ষার সময় রওশনকে বিয়ের প্রস্তাব পান তিনি। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে রওশন দ্বিতীয়। বিয়ের পর এরশাদ চলে যান পাকিস্তানের করাচীতে। সেখানেই চাকরি করতেন তিনি। মাত্র তিন দিনের ছুটিতে এসে রওশনকে বিয়ে করেন এরশাদ। বইতে সাবেক সেনা শাসক এরশাদ লিখেছেন, বিয়ের এক বছর স্ত্রীকে কাছে না পাওয়ায় পুরো সময় কেটেছে চরম বিরক্তে। বাবার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন রওশন। তাই চিঠি লেখা ছাড়া কোন পথ ছিল না। প্রতিদিন স্ত্রীকে একটি করে চিঠি লিখতাম। হাজার হাজার চিঠি লিখেছি তাকে। বইতে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, একটি চিঠি পোস্ট করার পর উত্তরের অপেক্ষায় থাকতাম। কখন উত্তর আসবে। রওশনকে আদর করে এরশাদ ডাকতেন ডেইজী বলে। স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে এরশাদ সম্বোধন করে বলতেন, ‘হৃদয়ের রাণী, ওগো মোর জীবন স্পন্ধন, ওগো একমুঠো রজনীগন্ধা, খুশি বউ, খুশি পাগলি, সোনাবউ, খু-খু বউ, ছোট্ট বউ, নটি গার্ল (দুষ্টু মেয়ে), মানস প্রতীমা, জীবন প্রদীপ, প্রাণ প্রতীমাসহ আরও অনেক কিছুই। স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বিদায় নিতেন নানা ভাষায়। আবেগময় নানা শব্দ চয়ন করতেন চিঠিতে। প্রেমিক এরশাদ বলে কথা। চিঠির শেষে তিনি লিখতেন,‘ইতি তোমার পেয়ারা, বিরহী, পাগল সাথী, এক অখ্যাত কবি, এক জাদুকর, প্রেম পুজারি, যে তোমাকে শুধু ব্যথাই দিল’ প্রভৃতি। মঙ্গলবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মিজানুর রহমান শেলী। বইতে রয়েছে ৪০০টি বড় অধ্যায়। গ্রন্থস্বত্ব দেয়া হয়েছে এরিখ এরশাদকে। এরশাদ তাঁর বাবা-মাকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন। আকাশ প্রকাশনীর প্রকাশ করা গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা। যা পাওয়া যাবে একুশের বইমেলাতেও। বইতে এরশাদ তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে, শিক্ষা, বাল্যকাল, চাকরি জীবন, বিবাহ, প্রেম, মামলা, রাষ্ট্রপতি থাকা, বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয়া, রাষ্ট্রপতি থাকা সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। বলেছেন, গ্রন্থে উল্লিখিত সব কথাই সত্য। এর এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। এরশাদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, চাকরি জীবনে স্ত্রীকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। হাজার হাজার চিঠি লিখেছি রওশনকে। এক সময় আমার সব চিঠিই স্ত্রী ফেরত দিয়েছেন সংরক্ষণের জন্য। আমি সব বাঁধাই করে সংগ্রহে রেখেছি। ইচ্ছে আছে চিঠিগুলো নিয়ে বই বের করার। তিনি বলেন, আমার চিঠি পেয়ে স্ত্রী আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতেন। আমাকে যে যাই বলুক মানুষকে ভালবাসী বলেই স্ত্রীর কাছে সুন্দর করে টিঠি লিখতে পেরেছি। গ্রন্থটি লিখতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে জানিয়ে এরশাদ বলেন, বই লেখার জন্য আমি আলাদা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। আমার বাড়িতে লেখার পরিবেশ নেই। ছেলে এরিখ আমার বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্কের নাম দিয়েছে ‘সুপারিশ ভবন’। যতক্ষণ বাড়িতে থাকি মানুষের ভিড়। সবার আবদার একটু সুপারিশ করার। সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ আরও বলেন, শেষ বয়সে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই। মানুষের ভালবাসা নিয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। একলা চলি পুলিশ লাগে না। মানুষকে ভালবাসী বলেই আমাকে কেউ আঘাত করে না। করবেও না। তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দল বেঁচে থাকলে তোমরা থাকবে। তোমরা আমায় মনে রাখবে। সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ বলেন, জনগণের কাছে শাসন পৌঁছে দেয়া না গেলে দেশের উন্নতি হয় না। দেশ সামনের দিকে যায় না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে দেশ এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে তা এখন অসম্ভব। পৃথিবীর কোন দেশেই তা এখন আর সম্ভব নয়। তাই বিকেন্দ্রীকরণ জরুরী। কিন্তু আমি এরশাদ বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব দিয়েছি বলেই কেউ সায় দিচ্ছে না। কেউ প্রাদেশিক ব্যবস্থার পক্ষে নয়। তিনি বলেন, সব দায়িত্ব সরকারী কর্মচারীদের হাতে এটা সঠিক নয়। সবার ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে এরশাদ বলেন, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এর আগে এরশাদ আরও বলেন, নিজের জীবনের বই লিখতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের কোথায় শুরু কোথায় শেষ কিভাবে বলব। জীবন আমার বহু ধারায় বিভক্ত। সৈনিক ছিলাম, রাষ্ট্রপতি ছিলাম, কবি ছিলাম, রাজনীতিবিদসহ নানা দিকে জীবনকে পরিচালিত করেছি। একদিকে পেয়েছি ভালবাসা অন্যদিকে পেয়েছি কট্টর সমালোচনা। রাজনীতি করে যেন অন্যায় করেছি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমি ক্ষমতা না নিলে আজ বাংলাদেশ কোথায় থাকত? আমরা আধুনিক সভ্যতা দেখতাম না। মধ্য আয়ের দেশ হতো না বাংলাদেশ। ক্ষমতায় থাকতে বিভিন্ন কর্মকা-ের কথা উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, আমার আত্মজীবনীর প্রতিটি কথা সত্য। কেন কিভাবে আমি স্বৈরাচার হলাম? কাদের স্বার্থে আমাকে স্বৈরাচার উপাধি দেয়া হলো বইতে উল্লেখ আছে। তিনি বলেন, আমার মতো স্বৈরাচারের জন্ম হলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। আমি দেশ ও মানুষকে এখনও ভালবাসী। ১৫টি কবিতার বই লিখেছি। এ নিয়ে হাস্যরস করেছেন অনেকে। সৈনিক ছিলাম বলে কবিতা লেখা কি অন্যায়? তবে আমাকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সাবেক সচিব এম মোকাম্মেল হক, লেখক মফিজুল ইসলাম, প্রকাশক আলমগীর সিকদার লোটন, ছড়াকার রফিকুল ইসলাম দাদুভাই প্রমুখ।
×