ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘাটতি রয়েছে সুশাসনের

বিসিবিতে স্বাধীন ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ টিআইবির

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিসিবিতে স্বাধীন ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ টিআইবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। তাই ক্রিকেটাঙ্গনে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধে ও আইনের সফল প্রয়োগ করতে সংগঠনটিতে স্বাধীন ন্যায়পাল নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানম-ির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কার্যালয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল করাপশন রিপোর্ট : স্পোর্ট, শীর্ষক এক প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন ও বিভিন্ন তথ্য সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সংঘটিত দুর্নীতির বিচারে সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। এজন্য বিসিবির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটকে (আকসু) আরও শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রণয়ন জরুরী। একইসঙ্গে ক্রিকেটের জন্য বিশেষায়িত স্বাধীন ন্যায়পাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিদেশী বাজিকরদের তৎপরতা, তরুণ ক্রিকেটার ও আম্পায়ারদের সংশ্লিষ্টতা, বিপিএলে পাতানো খেলায় ক্লাবের সংশ্লিষ্টতা এবং ক্রিকেট বোর্ড নির্বাচন ও পরিচালনায় সুশাসনের অভাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি। ড. জামান বলেন, বিসিবিতে রাজনৈতিক প্রভাবে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের মতো পদে মনোনীত করা হয়। বিসিবির সভাপতির অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন, আইনী অপরিপক্বতা, রাজনৈতিক ও দলীয়করণ এবং নানা প্রকার অনিয়মের কারণে এ ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া বিশ্বে খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনুযায়ী বিশ্ব ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে প্রথম হয়েছে পাকিস্তান এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশও ক্রিকেটে ফিক্সিংয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিসিবির বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একজন বোর্ড সভাপতি, ২৭ জন বোর্ড পরিচালক এবং ২০টি পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। বর্তমান নেতৃত্বের স্বার্থে পরিচালকরা একতরফা গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছেন। সেখানে সভাপতি নিজেই সাধারণ পরিষদের ৫ জন কাউন্সিলর নির্বাচন করেন এবং পরিচালনা কমিটিগুলোর সদস্য নির্বাচন করেন। যার কারণে সভাপতি তার পছন্দের ব্যক্তি দ্বারা বোর্ডে সহজেই অবৈধ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন। বোর্ডকে রাজনৈতিকীকরণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১২ সালের মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো বিসিবির সংবিধান সংশোধন করার পর বর্তমান সভাপতি সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়। এই নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন সত্ত্বেও সভাপতি ও পরিচালক পদে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। সারাদেশ থেকে প্রতিনিধি নেয়ার কথা থাকলেও দুই-তিনজন ছাড়া অধিকাংশ বোর্ড সদস্য ঢাকা ভিত্তিক ক্লাবগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন এবং যাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংযোগ আছে। এমনকি ম্যাচের ভ্যানু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দুর্নীতিকে না বলা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত পজেটিভ বলে জানান তিনি। ড. ইফতেখার বলেন, ক্রিকেট বিশ্বে ফিক্সিংয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনুযায়ী বিশ্ব ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে প্রথম হয়েছে পাকিস্তান এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। এ পর্যন্ত এই দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন পাকিস্তানের ৬ জন এবং ভারতের ৫ জন খেলোয়াড়। যেখানে বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের তালিকায় আছেন একজন। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষয়টি বহু পুরনো। ১৯৯৪-৯৫ থেকে এই দুর্নীতির উত্থান শুরু হয়। প্রথমে এই দুর্নীতি নজর কাড়ে ১৯৯৮ সালে। অস্ট্রেলিয়ার দুইজন খেলোয়াড় শেন ওয়ার্ন এবং মার্ক ওয়াহ এই দুর্নীতির মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। পরে একাধারে দক্ষিণ আফ্রিকার ৪ জন, নিউজিল্যান্ডের ১ জন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১ জন, শ্রীলঙ্কার ১ জন, কেনিয়ার ১ জন এবং বাংলাদেশের ১ জন খেলোয়াড় এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এদের সবারই বিচারকার্য শেষে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও হয়েছে। তবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি খেলা সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে। বাংলাদেশ ম্যাচ ফিক্সিংয়ে ঝুঁকিতে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বৈশ্বিক ক্রিকেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রিকেট আমাদের অনেক গৌরবের বিষয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট ও ওয়ানডে ম্যাচে ভাল করছে। ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভের জন্য বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) যোগ দিচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং, ইললিগ্যাল ব্যাটিংয়ের ঝুঁকি দিন বাড়ছে তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটও রয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে দুর্নীতি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশে কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ১৮৬০ সালের বাংলাদেশ দ-বিধি এবং ২০০৪ সালের দুদক আইনে অসদাচরণ ও দুর্নীতির কথা বলা আছে। কিন্তু ক্রিকেটে দুর্নীতি তদন্তের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া উল্লেখ নেই। এজন্য ন্যায়পাল নিয়োগ করা প্রয়োজন। খেলাধুলার অপরাধ সম্পর্কে এন্টি করাপশন ইউনিটকে কার্যকর করতে হবে। টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিপিএলের প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট ছিল কিছুটা সমস্যাপূর্ণ। এটা হয়েছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে, যেখানে টুর্নামেন্টের জন্য উপযুক্ত নীতি বা বিধান ছিল না। সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি ছাড়াই ফ্র্যাঞ্জাইগুলো খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের হার নির্ধারণ করেছিল। খেলোয়াড়দের সাধারণভাবে নগদ অর্থ প্রদান করায় কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি এসব কর্মকা-ে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিবছর ১৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। আর এই অর্থের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব ক্রিকেটাঙ্গনে দিন দিন অনিয়ম বাড়ছে। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ভার্সন বিশেষ করে বিপিএলে খেলোয়াড়, দল, সংগঠন এবং অন্য অংশীদারদের জন্য দ্রুত অর্থ লাভ করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত ব্যক্তিরা এ ব্যবসার উদ্যোগের কোন একদিকে সংশ্লিষ্টতার নামে এত অনুপ্রবেশ করে খেলোয়াড়, আম্পায়ার, দল, সংগঠকদের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তোলো। এসব সম্পর্ক এক সময় যোগসাজশে খেলায় বিভিন্ন ধরনের ফিক্সিংয়ের ঘটনা ঘটায়। টিআইএর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নে টিআইবি বেশ কিছু সুপারিশ ভুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে প্রয়োজনীয় দক্ষজনবল ও কারিগরি উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে দুর্নীতিবিরোধী ইউনিটের স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিতকরণ; ফিক্সিং, প্রতারণার অন্যান্য কৌশল নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন সংস্কার করা ও তার কার্যকরী বাস্তবায়ন করা; বিসিবির পরিচালনা উন্নততর করতে একে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদারকির আওতায় নিয়ে আসা এবং বিসিবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বপ্রণোদিতভাবে আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করা ও তথ্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে আইনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসানসহ টিআইবির অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×