ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক ডজন অভিযোগ প্রকাশকদের, নাকচ একাডেমির

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এক ডজন অভিযোগ প্রকাশকদের, নাকচ একাডেমির

মোরসালিন মিজান ॥ এক মাসের মেলা। দীর্ঘ এক মাস! কিছু কি টের পাওয়া গেল? অথচ সময় কিন্তু শেষ! হাতে মাত্র কয়েকটা দিন। দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাবে। প্রিয় আর প্রাণের মেলা বলেই হয়ত এত দ্রুত চলে যায়। এত দ্রুত চলে যাচ্ছে। শেষ বেলায় এসে কিছুটা কমেছে অকারণ ঘুরে বেড়ানো। পাঠক মাত্রই কেনায় মনোযোগী হয়েছেন। জনপ্রিয় লেখকদের বই শুরু থেকেই বেদম বিক্রি হয়েছে। এখন সিরিয়াস বইটিও নিজ গরজে খুঁজে নিচ্ছেন পাঠক। মঙ্গলবার মেলা ঘুরে এমন ধারণা হয়েছে। বিভিন্ন স্টলের সামেন গিয়ে দেখা যায়, তালিকা ধরে বই কিনছেন পাঠক। ধ্রুপদী সাহিত্য ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা অনুবাদ প্রবন্ধ খেলাধুলাÑ কোন বিষয়ের বই অবিক্রীত থাকছে না। বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন তথ্য। পাঠক সমাবেশের স্টলে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, জনপ্রিয় বইয়ের মতোই বিক্রি হচ্ছে ‘প্লেটো : রিপাবলিকÑ রাজনৈতিক ন্যায়নৈতিকতা সম্পর্কে।’ একই রকম আগ্রহ নিয়ে পাঠক কিনছেন ‘ভাষান্তরসমগ্রÑভাষান্তরিত গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাতকার।’ বিক্রি হচ্ছে ‘মীর মশাররফ হোসেনের অপ্রকাশিত ডায়েরি।’ আগামী থেকে ভাল বিক্রি হচ্ছে কর্নেল শওকত আলীর বই ‘গণপরিষদ থেকে নবম জাতীয় সংসদ’। অন্যপ্রকাশ মূলত হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের। একই স্টল থেকে পাঠক আগ্রহ নিয়ে কিনছেন বিখ্যাত লেখকদের সেরা গল্পের সিরিজ প্রকাশনাটি। মানসম্পন্ন প্রকাশনার জন্য সুনাম আছে এ্যাডর্নের। এখান থেকে বেশকিছু বই ভাল বিক্রি হচ্ছে। মঙ্গলবার কিছু সময় স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, সন্তান রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বইয়ের অনুবাদ ‘আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ’ ভাল বিক্রি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বহুমাত্রিক মূল্যায়ন গ্রন্থ ‘বজ্রকণ্ঠ ও স্বাধীনতা’র বিক্রিও দেখার মতো। ঐতিহ্য থেকে অন্য আরও বইয়ের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে জাফর ইমাম বীর বিক্রমের বই ‘দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা।’ মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে ‘হরিশংকর জলদাসের গল্পসমগ্র ১’। এটিরও চাহিদা উল্লেখ করার মতো। বাংলা প্রকাশ থেকে ভাল বিক্রি হচ্ছে সালভাদর দালি থেকে করা অনুবাদ গ্রন্থ ‘মিস বাংলাদেশ’। এভাবে অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস বিষয়ে লেখা বই এখন ভাল বিক্রি হচ্ছে। এই ধরনের বইগুলো কিনতে কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়েন না। তবে প্রচুর কিনছেন। এদিকে, বই বিক্রি ছাড়াও শেষ বেলার হিসাব নিকাষ শুরু করে দিয়েছেন প্রকাশকরা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৩তম দিনে মঙ্গলবার মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে এক ডজন অভিযোগ করেছেন তারা। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে লেখা এক চিঠিটিতে মেলার নানা অসঙ্গতির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, এ বছর মেলায় বিভিন্ন স্টলে পাইরেটেড বই বিক্রি হচ্ছে। বেআইনীভাবে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় লেখকদের বই। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অপ্রকাশক বিভিন্ন এনজিওকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের খোলা জায়গার অনেকটা দখল করে নিয়েছে সিসিমপুর প্রকাশনা। মেলার কোন কোন অংশে রাতে আলোর সঙ্কট দেখা দেয়। পানিরও ব্যবস্থা থাকে না। মেলার প্রবেশদ্বার তিনটি হলেও দুটো দ্বার দিয়েই প্রবেশ কেবল প্রবেশ করা যাচ্ছে। মেলার ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে কোন পানির ব্যবস্থা নেই। পানি ছিটানোর ক্ষেত্রেও আছে বৈষম্য। বিভিন্ন ইউনিটের স্টলের অবকাঠামো নির্মাণে অসাম্য। গুচ্ছ স্টল সমন্বয় করা হয়নি। স্টলের ক্রম ধারাবাহিকতা নেই। প্রতিবছর লটারির আগে সম্বর বসানো হয়, এবার তার উল্টো হয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ায় অনেকে এখনও বাংলা একাডেমিকেই মেলার মূল অংশ মনে করছেন। স্টলের বিন্যাসের ক্ষেত্রে বড় বড় এবং প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয় চিঠিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব অভিযোগ কেবল প্রকাশকদের। বইপ্রেমী পাঠকদেরও এবার নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আছে অজস্র অভিযোগ। তবে, একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এসব অভিযোগ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার পক্ষে নন একদমই। মেলা শুরুর পর থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। এ অবস্থায় মঙ্গলবার মুখ খুললেন প্রকাশকরা এবং যথারীতি বাংলা একাডেমি ওসব অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল! চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে একাডেমির মহাপরিচালক মঙ্গলবার সাংবাদিকদের যা বলেছেন তাতে মেলাটা প্রকাশকদের বলে মনে হয় না। প্রকাশকদের কেবল মেলা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অভিযোগগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা মেলা করুক না, ভুলই ধরবে শুধু? বলার ধরনটিও লক্ষ্য করার মতো। মহাপরিচালক বলেন, প্রকাশকরা কোন দায়িত্বের বেলায় নেই, শুধুই অভিযোগ করেন। তারা প্রকাশক। তারা বইয়ের বিক্রেতা। এ ছাড়া আর কিছু নয়। সোমবার মেলার একটি স্টলে আগুন লাগার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে তারা কি কেউ এসেছিলেন? আমরাও তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ। তারা কিছু করছেন না। কেবল অভিযোগই করছেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পাল্টা বক্তব্য সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে যায় প্রকাশকদের কানে। এ প্রসঙ্গে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চাই অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজনটি আরও সফল হোক। এ জন্য আমাদের চেষ্টার কোন অন্ত নেই। এবারের মেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা ভাল করে দেখে, পর্যবেক্ষণ করে একটি চিঠি দিয়েছি একাডেমি বরাবর। আমাদের আশা ছিল, এই মেলার ত্রুটিবিচ্যুতি স্বীকার করে নিয়ে একাডেমি সামনের দিকে তাকাবে। আগামী বছরের মেলায় যাতে আরও সুন্দর ও সফল হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু চিঠির জবাবে মহাপরিচালক গণমাধ্যমে যা বলেছেন তা এক কথায় দুঃখজনক। একাডেমির মহাপরিচালক প্রকাশকদের মর্যাদা দিতে চান না। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে এই প্রকাশকদের অবদান স্মরণে রাখার পরামর্শ দেন তিনি। নতুন বই মেলায় প্রতিদিনই আসছে নতুন বই। ২৩তম দিনে একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়েছে ৬৪টি নতুন বই। নির্বাচিত বই মেলায় উৎস প্রকাশন থেকে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা ‘যুদ্ধযাত্রা একাত্তর’। লেখক আবদুল মালীক ফারুক। সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধ করেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা, সেই আনন্দ-বেদনার ইতিহাস ফিরে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখক। জ্যোতি প্রকাশ থেকে এসেছে তৌহিদুর রহমানের উপন্যাস ‘শঙ্খচিলের মৃত্যুদৃশ্যের পর’। কথাশিল্পী একাত্তরের এক বীরাঙ্গনা মায়ের জীবন থেকে নিয়েছেন। কল্পনা নয়, বরং বাস্তব চরিত্রকে উপন্যাসের মৌল উপাদান করেছেন তিনি। হাতেখড়ি থেকে এসেছে গোলাম কুদ্দুছের লেখা ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ থেকে ৮১’। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর যে বন্ধ্যা সময়, সেই সময়ের রাজনীতি নিয়ে পাঠকের কৌতূহল পূরণের চেষ্টা করেছেন লেখক। কথা প্রকাশ থেকে এসেছে ‘বাংলাদেশের বাউল সমাজ ॥ সাহিত্য ও সঙ্গীত’। লিখেছেন ডক্টর আনোয়ারুল করীম। গবেষণা গ্রন্থে বাউলের সমাজ, সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বিশদভাবে তথ্যসহ বর্ণনা করা হয়েছে। ঐতিহ্য থেকে মেলায় এসেছে অদিতি ফাল্গুনীর গল্পের বই ‘প্রমথেশ প্রমিথিউস’। সঙ্কলনে মোট ১৬টি স্থান পেয়েছে। মেলায় এসেছে এমএ ওয়াহিদের লেখা বই ‘নজরুলের জীবনে নার্গিস’। নজরুল ও নার্গিসের প্রেম বিরহের আখ্যান প্রকাশ করেছে রিদম প্রকাশনা সংস্থা। তাম্রলিপি থেকে এসেছে উপন্যাস ‘স্বর্ণপ্রাতে’। লিখেছেন শাহরিয়ার হোসেন। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট- ১৯২৪ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নানাভাবে ভাষায় দৃশ্যমান। উত্তাল ও অনিশ্চিত এই সময়ের তিন চরিত্র তনু, অরুণ ও রজনী। এই চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়েই সময়ের গল্প বলে যান লেখক। অ্যাডর্ন থেকে এসেছে জামাল উদ্দীনের গল্পগ্রন্থ ‘চুনমুখো চাঁদরাতে’। প্রকাশকের মতে, নয়টি গল্পের প্রতিটি চরিত্রের আদল উপমা প্রতীকী রূপ একে অন্যকে ছাপিয়ে গেছে। মেলা মঞ্চের আয়োজন গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘মোহাম্মদ নাসির আলী জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি আসাদ চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন এবং শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন লেখক-গবেষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। প্রাবন্ধিক বলেন, শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই মোহাম্মদ নাসির আলী সমধিকখ্যাত এবং প্রতিষ্ঠিত। একান্ত নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা এবং সাধনা দিয়ে এ দেশের শিশুসাহিত্যের অঙ্গনকে তিনি উর্বর করেছেন। তার সামগ্রিক রচনাবলী প্রমাণ করবে যে তিনি একজন স্বাপ্নিক মানুষের মতো শিশুসাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তার একান্ত ইচ্ছে ছিল শিশুরা এই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর রূপকে আবিষ্কার করবে। যে কারণে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উপাখ্যান, লোককথা, রূপকথা, উপকথা ও অভিযানকাহিনীকে নিজস্ব রচনাশৈলীতে প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, নাসির আলীর রচনাবলী ছিল বৈচিত্র্যময়। নিজস্ব মেধা প্রয়োগ করে তিনি এ দেশের শিশুসাহিত্যের অনুর্বর ক্ষেত্রকে ক্রমাগত উর্বর করে তুলতে পেরেছিলেন। কাহিনী নির্বাচনে এবং রচনাশৈলীতেও রেখেছেন মৌলিকতার স্বাক্ষর। আলোচকরা বলেন, বাংলা শিশুসাহিত্যে মোহাম্মদ নাসির আলীর অবদান অবিস্মরণীয়। আজ আমাদের শিশুসাহিত্য যে বিপুলতা ও বৈভবের অধিকারী তার নেপথ্যে নাসির আলীর ভূমিকা অসামান্য। এদেশের শিশুসাহিত্যের ভিত মজবুত করতে তিনি বিচিত্র শাখায় কাজ করেছেন। তারা বলেন, জন্মশতবর্ষে মোহাম্মদ নাসির আলীকে স্মরণের মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি একটি গুরুদায়িত্ব পালন করল। সভাপতির বক্তব্যে ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, মোহাম্মদ নাসির আলী ও তার প্রজন্মের লেখকবৃন্দ নিজেদের মেধা ও শ্রমে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যকে যেভাবে স্বাবলম্বী ও বর্ণিল করেছেন সে জন্য তাদের ঋণ আমরা সব সময় মনে রাখব। একই সঙ্গে জন্মশতবর্ষে মোহাম্মদ নাসির আলীর রচনার নিবিড় পাঠ ও বিশ্লেষণও প্রয়োজন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন ড. মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, সায়েরা হাবীব, ইমরুল ইউসুফ, আবিদ করিম, খোদেজা বেগম, আব্দুস সালাম। সঙ্গীত পরিবেশন করেন মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ, অদিতি ফাল্গুনী, মোস্তাক আহমেদ, মোঃ নাসিরুল ইসলাম, ডাঃ রেজাউর রহমান, মোঃ আরিফুর রহমান, মোঃ আবুল কালাম, আসাদ আহমেদ, মাহবুবা রহমান, আবু শামস্ নূর মোহাম্মদ, মোঃ মনিরুজ্জামান, ফারহানা শিরিন, আইয়ুব মুহাম্মদ খান, মোঃ আনোয়ার হোসেন, সঞ্জয় কুমার দাস, মীর তারিকুল ইসলাম, মোঃ রফিকুল ইসলাম এবং মোঃ দেলোয়ার হোসেন।
×