ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শুক্রবার থেকে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের মূল পাইল স্থাপন শুরু

পদ্মার বুকে ভাসছে মূল সেতু কাজের ৯২ ও নদী শাসনের ৪৫ ক্রেন

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পদ্মার বুকে ভাসছে মূল সেতু কাজের ৯২ ও নদী শাসনের ৪৫ ক্রেন

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে ॥ পদ্মা সেতু ঘিরে বিশাল কর্মযজ্ঞ আরও বিস্তৃত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ চলছে এখন সমান গতিতে। ইতোমধ্যেই পাঁচটি মূল পাইল স্থাপিত হয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে আরও দুটি মূল পাইল স্থাপন শুরু হয়েছে। এই দুটি পিলারে মোট বারোটি পাইল স্থাপন করতে হবে। জার্মানিতে তৈরি ২ হাজার ৪শ’ কিলো জুল ক্ষমতার হ্যামারের হাতুড়ি দিয়ে মূল পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া ৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারের কাছে আরও দুটি ট্রায়াল পাইল স্থাপানের কাজ চলছে। ৩৯ নম্বর পিলারের কাছে চলছে টেস্টিং পাইলের কাজ। সেতুর দু’প্রান্তের কাজে আরও অগ্রগতি এসেছে। নদী শাসন চলছে দ্রুত। চারদিকে এখন শুধু কাজ আর কাজ। পদ্মার দু’প্রান্তে কর্মযজ্ঞের বাইরেও বিশাল এলকাজুড়ে রেলপথ নিয়ে বড় নির্মাণযজ্ঞের প্রক্রিয়া চলছে। লক্ষ্য সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গেই রেল যোগাযোগ চালু করা। ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’র কাজের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর ছয় জেলায় রেলের জন্য ৫৮৮ দশমিক ২৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক এসকে চক্রবর্তী শুক্রবার দুপুরে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে রেলের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। একই সঙ্গে ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর সঙ্গেই রেল চালু সম্ভব হবে। এই সময়ের মধ্যে রেললাইন সম্প্রসারণ করে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সেতু পার করে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। তবে ঢাকা পর্যন্ত এই লাইন সম্প্রসারণে আর এক বছর লেগে যেতে পারে বলে তিনি আভাস দেন। এদিকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে ‘ফাস্ট ট্যাক’ তালিকায়। গুরুত্ব বিবেচনায় ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির পরবর্তী সভায় তা উপস্থাপন করা হচ্ছে। পদ্মার ওপর দিয়ে ’১৮ সালের মধ্যে একসঙ্গে সড়ক ও রেলপথ চালু করতে চায় সরকার। এজন্য রেল সংযোগ প্রকল্পটিও দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রেলপথ ॥ পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিমি রেলপথ নির্মাণ করা হবে। মূল পদ্মা সেতু ও নদীশাসনের কাজ পেয়েছে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। রেলপথ নির্মাণের কাজও করবে চীন সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। মূল সেতুতে রেল সংযোগসহ একদিকে ঢাকা ও অন্যদিকে যশোর পর্যন্ত এই রেলপথ হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মাণ করা হবে রেলপথ। প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। মূল পদ্মা সেতুতে বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা জেলায় ৭১ দশমিক ৩২ একর, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ১৫ দশমিক ৮৫ একর, মুন্সীগঞ্জ জেলায় ১৩৭ দশমিক ৮১ একর, শরীয়তপুর জেলায় ৩ দশমিক ৯৪ একর, মাদারীপুর জেলায় ২১৩ দশমিক ৮৮ একর ও ফরিদপুর জেলায় ১৪৫ দশমিক ৪৪ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। মুন্সীগঞ্জ জেলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি যৌথ সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। সে অনুযায়ী সিরাজদিখান উপজেলায় ৭৪ দশমিক ৪৩ একর, শ্রীনগর উপজেলায় ৫৭ একর এবং শ্রীনগর উপজেলায় ৪ দশমিক ৩৬ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্য পাঁচ জেলায়ও একইভাবে দ্রুত জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৮৬ দশমিক ৮১৭৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই অনুমোদন হয়েছে। মঙ্গলবার ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটির ১০৬তম সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুন্সীগঞ্জ জেলায় মোট ২২ মৌজা দিয়ে প্রবাহিত হবে রেললাইন। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পদ্মা সেতু পার হয়েই মাওয়ার কাছে দোগাছি দিয়ে রেললাইন ক্রস করবে মহাসড়কটি। মহাসড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে রেললাইন এসে আবার কেয়াইন মৌজা দিয়ে মহাসড়ক ক্রস করে আবার পশ্চিম পাশে আসবে। তবে দু’বার মহাসড়ক ক্রস না করে মহাসড়কের পূর্ব পাশ দিয়ে রেললাইন নেয়ার ব্যাপারেও আলোচনা রয়েছে। এর আগে রেলের জন্য পদ্মা সেতুর রেল ভয়াডাকের জন্য লৌহজং ও শ্রীনগর উপজেলার ৮টি মৌজায় আরও ৫৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল জানান, রেল লাইনের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া অতি গুরুত্বের সঙ্গে চলছে। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি রেল যোগাযোগ এই অঞ্চলসহ গোটা দেশের অর্থনীতি আমূল পরিবর্তন আনতেই সরকার গুরুত্বের সঙ্গে প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। প্রথমে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিমি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। পরে বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে আলোচনার পর অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ায় এখন রেলপথ নির্মাণ করা হবে ১৬৯ । এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত নির্মিতব্য রেলপথের ২১ অংশ হবে উড়াল রেলপথ। এই অংশের মধ্যে আবার তিন হবে ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রেলপথটি গে-ারিয়া পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে এটি বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী-১, ধলেশ্বরী-২, নদীর ওপর দিয়ে মাওয়ায় যাবে। মাওয়ায় উড়াল পথ হয়ে রেলপথটি সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে যাবে যশোরের সিঙ্গিয়া পর্যন্ত। এই রেলপথে ১২০ কিমি বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার মানুষ রেল সেবার আওতায় আসবে। প্রকল্পের আওতায় চারটি বড় ও ৫৬ ছোট রেলসেতু, পাঁচটি লেভেলক্রসিং, ৪০ স্থানে আন্ডারপাসসহ জাতীয় মহাসড়কে তিনটি উড়াল সড়ক নির্মাণের দরকার হবে। জানা গেছে, ঢাকার গে-ারিয়া পর্যন্ত চার রেলপথ নিম্নমানের। এ পথের আমূল সংস্কার করতে হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ট্রেন চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়া থেকে জাজিরা প্রান্তসহ প্রথম ধাপে রাজধানীর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনেই ব্যয় হবে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেল সংযোগের জন্য এরই মধ্যে পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-পুকুরিয়া-ভাঙ্গা অংশে ৬০ কিমি রেলপথ সংস্কার করা হয়েছে। রাজধানীর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ৪৪ দশমিক ৩২ কিমি। প্রস্তাবিত দোতলা পদ্মা সেতুর নিচের তলায় ৬ দশমিক ১৫ , সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ হবে ৩১ দশমিক ৮৫ কিমি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে-ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজং, জাজিরা, শিবচর ও ভাঙ্গা উপজেলার ৮৮ মৌজার ওপর দিয়ে রেলপথ বসাতে হবে। পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ বাড়ছে ॥ নদীর তীরে ও মাঝখানে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশী-বিদেশী শ্রমিকরা। জাজিরার কাছে পদ্মার বুকে বিশাল আকারের ড্রেজার কাজ করছে নদী শাসনে। এই বালু ফেলা হচ্ছে মাঝ পদ্মার পাইনপাড়ার চরে। বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে সেখানে কাজ করছেন চীনা ক্রুরা। বালু তোলা হচ্ছে, কাদামাটি সরানো হচ্ছে। নদীপারে এক জায়গায় স্তূপ করে রাখা কংক্রিটের অসংখ্য ব্লক। মাওয়া প্রান্তে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার বিশেষ আকারের জিও ব্যাগ। নদী শাসনের ঠিকাদার সিনো হাইড্রো কোম্পানির প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন আসন্ন বর্ষার আগেই মে মাসের মধ্যে নদী শাসনের কাজে আমূল অগ্রগতি হবে। নদীর মাঝখানে লাল-সাদা রঙের শতাধিক ক্রেন। বিশেষ পদ্ধতিতে নদীকে ৮০ ফুট গভীর করতে মাটি কাটছে বিশাল আকৃতির ড্রেজারগুলো। মাওয়ায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের কারখানা থেকে বের হচ্ছে একের পর এক পাইল। সব মিলিয়ে পদ্মার বুক ও এর দুই পাশে জাজিরা-মাওয়ায় এখন চলছে নির্মাণ উৎসব। মূল সেতুর কাজ করছে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি (এমবিইসি)। প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, নদীর তলদেশে আছে দুর্বল পলিমাটি। পাইলিংয়ের সময় তলদেশের পলিমাটি হঠাৎ সরে গিয়ে ২০০-৩০০ মিটারের খাদ সৃষ্টি হতে পারে। তাই ৪০০ মিটার গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে পাইল। নদীর গভীরতম স্থানে পাইল নিয়ে যেতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জার্মানির হ্যামার পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। পদ্মার বুকে ভাসছে ১৩৭ ক্রেন। মূল সেতুর কাজে ৯২ ও নদী শাসনের জন্য আছে ৪৫ ক্রেন।
×