দৃশ্যটা সত্যি দেখার মতো। যেদিকে চোখ যায়, বইপ্রেমী মানুষের ঢল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপুল বিশাল পরিসর। বাংলা একাডেমির খোলা জায়গা। উভয় অংশে জনস্রোত। কানায় কানায় পরিপূর্ণ। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১২তম দিনে দেখা গেল এমন চোখ জোড়ানো দৃশ্য। ছুটির দিনে শুক্রবার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল ঋতুরাজ বসন্তও। দুয়ে মিলে দারুণ জমে উঠে মেলা।
একেবারে শুরু থেকেই লোকে লোকারণ্য ছিল মেলা। বেলা যত গড়িয়েছে লাইন তত দীর্ঘ হয়েছে। একপর্যায়ে কোথায় লাইনের শুরু আর কোথায় শেষ বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু হওয়া লাইন পেছনে টিএসসি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি অংশ ও কালীমন্দির অংশে নতুন দুটি প্রবেশ পথ। এ পথগুলোর খোঁজ অনেকে জানতেনও না। অথচ এদিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। সাপের মতো এঁকে বেঁকে যাওয়া লাইনের লোক গুনে শেষ করা যায় না। বাইরে যে উপস্থিতি, ভেতরে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। একাডেমি চত্বরে কম জায়গা নয়। পুরোটা লোকে লোকারণ্য। গায়ে গা লেগে থাকে। এ অবস্থা মেনে নিয়েই বই দেখছিলেন তারা। কেউ কেউ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে ছুটেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। সেখানে প্রবেশ করে আবারও অবাক হতে হয়। মানুষ আর মানুষ। বইয়ের কোন মেলায় এমন বাঁধ ভাঙা জোয়ার! ভাবাই যায় না। মন ভাল হয়ে যায়। বসন্ত যখন জাগ্রত দ্বারে, রুচিশীল পাঠকের বড় অংশটি ডুবেছিল কবিতায়। বিভিন্ন স্টল ঘুরে প্রিয় কবিদের নতুন কাব্যগ্রন্থের খোঁজ নিয়েছেন তাঁরা। কিছু কবিতা চিরকালের। সেইসব কবিতার সঙ্কলন কিনেছেন। প্রকাশকরাও মোটামুটি সামনের দিকে সাজিয়ে রেখেছিলেন কবিতার বই। খ্যাতিমান কবিদের নির্বাচিত কবিতা নিয়ে বিশেষ সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অবসর। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আহসান হাবীব, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হকসহ সাত কবির কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে পৃথক সাতটি কাব্য গ্রন্থ। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া গেল শহীদ কাদরীর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। একই কবির আরেকটি কাব্যগ্রন্থে কেবলই প্রেমের কবিতা। শিরোনাম তোমার জন্য। এখানেই আছে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ শিরোনামের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটি। আগামী প্রকাশনী থেকে সংগ্রহ করা যাবে হুমায়ুন আজাদের অধিকাংশ কবিতা। নানা শিরোনামে প্রকাশ করেছে প্রগতিশীল এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এ্যাডর্ন প্রকাশ করেছে কালাতীত ইংরেজী কবিতা সঙ্কলন ‘শেক্সপিয়র থেকে কীটস রবার্ট ফ্রস্ট থেকে ইলিয়ট’। অনুবাদ করেছেন রহমান ম. মাহবুব। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে কাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচিত গানের অনুবাদ ‘দি রিটার্ন অব লাইলী’। অনুবাদ করেছেন ড. নাশিদ কামাল। কবি প্রকাশন নামের ছোট্ট একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল জনপ্রিয় অনেক কবির কবিতা। বিনয় মজুমদারের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বিরতিহীন উৎসব’, মহাদেব সাহার ‘নির্বাচিত ১৫০ কবিতা’, নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন প্রকাশক। প্ল্যাটফর্ম নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে আবু হাসান শাহরিয়ারের নতুন কাব্য গ্রন্থ ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। তাম্রলিপি থেকে এসেছে গুলতেকিন খানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’। এই কবির জীবনের গল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হুমায়ূন আহমেদ নামটি। নন্দিত কথাসাহিত্যিকের সংস্পর্শে থাকার কারণে হয়ত নিজের একান্ত প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেননি। এবারের মেলায় সেই চেষ্টা। কাব্য ভাষায় নিজের মনের ভাব যতটা সম্ভব প্রকাশ করেছেন তিনি। নানা কারণেই কাব্য গ্রন্থটি আগ্রহের কেন্দ্রে চলে এসেছে। নবীন ও প্রতিশ্রুতিশীল কবিদের কবিতার বইও দেখা গেছে বিভিন্ন স্টলে। ‘ষড়ঋতুর ছড়া কবিতা গান’ শিরোনামে সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে নালন্দা। এভাবে ছড়া কবিতা গানের চমৎকার সংগ্রহ হয়ে ওঠেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আজ বসন্ত দিনে নিশ্চয়ই দীর্ঘ তালিকা থেকে পছন্দের বই সংগ্রহ করবেন পাঠক।
শিশুপ্রহর ॥ সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। বিচারকম-লীর সদস্য ছিলেন আনিসুর রহমান তনু, ইয়াকুব আলী খান এবং সাগরিকা জামালী। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। প্রতিযোগিতায় দুই শতাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১২তম দিনে শুক্রবার মেলায় এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমিতে জমা পরা নতুন বইয়ের সংখ্যা ২৮০টি।
মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে নজরুলচর্চা : অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহীত উল আলম, কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজ এবং কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত নজরুল গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশে নজরুলচর্চার অতীত ও বর্তমানের মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি প্রতিষ্ঠানÑ বাংলা একাডেমি ও নজরুল ইনস্টিটিউট। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নজরুলচর্চার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালে ‘নজরুল-রচনাবলী’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এর সূত্রপাত। বিগত তিন দশকে নজরুল-রচনাবলীর অনেক সংস্করণ প্রকাশ, অপ্রকাশিত রচনা সংগ্রহ, নজরুলের জীবন ও সৃষ্টির অজানা অধ্যায়ের আবিষ্কার নজরুলচর্চাকে নিঃসন্দেহে বেগবান করেছে। ১৯৮৫ সালে সরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠে নজরুল ইনস্টিটিউট। এর নামের মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশে নজরুলচর্চার অমিত সম্ভাবনার ইঙ্গিত। বিগত দুই যুগে নজরুল চর্চার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে নজরুল বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গুণগতমানে কয়টি গ্রন্থ কালের বিচারে উত্তীর্ণ হবে, সেটা সময় বলে দেবে। এই বাজারী সভ্যতায় নজরুলচর্চা যেন নজরুল ব্যবসায় পরিণত না হয়, সংশ্লিষ্টদের সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
কারণ নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, চেতনার আলোকবর্তিকা। আলোচকরা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক নজরুলচর্চার সমান্তরালে মানুষের ভালবাসায় নজরুল সবসময় চর্চিত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। বাংলা একাডেমি যেমন নজরুল রচনার প্রামাণ্য সংস্করণ প্রকাশ করেছে তেমনি নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলের গানের শুদ্ধ সুর ও বাণী সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে নজরুলচর্চার ভিতকে মজবুত করেছে। তারা বলেন, এখন প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক সৃজনশীল অনুবাদের প্রক্রিয়ায় বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ সমন্বয়বাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও জীবনদর্শন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া।
সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নজরুলচর্চা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশেষ করে নজরুলের অমর রচনাকর্ম ইংরেজী, উর্দু, হিন্দী, ফারসী এমনকি স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ভাষায়ও অনূদিত হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে বাংলার নজরুল পৌঁছে যাবে সারাবিশ্বে।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীহার দে আকাশের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সুরের আলো সঙ্গীত একাডেমি’র শিল্পীবৃন্দ। এছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী খালিদ হোসেন, লিলি ইসলাম, নাশিদ কামাল, সালাউদ্দীন আহমদ, লীনা তাপসী এবং আবদুল ওয়াদুদ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: