ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিরাজদের ৩ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, প্রতিপক্ষ ভারত

ফাইনালের স্বপ্ন ধূলিসাত বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ফাইনালের স্বপ্ন ধূলিসাত বাংলাদেশের

মিথুন আশরাফ ॥ নয় বলে জিততে ১ রান দরকার। নিশ্চিত জয়ই হতে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব দলের। এমন সময়ে কাভার দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়েই নাচতে শুরু করলেন শামার স্প্রিঙ্গার। বাংলাদেশকে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা যে নিশ্চিত করে নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্প্রিঙ্গারের অপরাজিত ৬২ রানের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়েই যে তা সম্ভব হয়েছে। প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপে ফাইনালে খেলার স্বপ্ন সেই সঙ্গে ধূলিস্মাতও হয়ে গেছে বাংলাদেশের। টস জিতে আগে ব্যাটিং নেয়াটাই তাহলে বিপদ ডেকে আনল। সেই বিপদ ‘যেন-তেন’ নয়, সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় ঘটল। অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন মিরাজ, শান্ত, জাকির, সাইফুদ্দিন, শাওনরা; তা নিমিষেই ধূলিস্মাত হয়ে গেল। ফাইনালে ওঠার আশাই তো পূরণ হলো না। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার সেমিফাইনালে জিতে এখন ফাইনালে খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রবিবার ভারত যুব দলের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে অংশ নেবে শিমরন হেটমায়ারের দল। আর শনিবার ফতুল্লায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে খেলবে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে আগেরদিন বাংলাদেশ যুব দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ বলেছিলেন, ‘আমাদের স্পিন ও ব্যাটিংটা অনেক শক্তিশালী।’ স্পিনটা ভাল করা গেলেও ব্যাটিংটাই ডুবিয়ে দিল। টস জিতে বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং নিল বাংলাদেশ। যেন স্কোরবোর্ডে বেশি রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চাপে ফেলা যায়। এরপর স্পিন ‘বিষে’ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ‘লাল’ করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শুরুর ব্যাটসম্যানদের খামখেয়ালি ব্যাটিংয়ে বড় স্কোর গড়া গেল না। অধিনায়ক মিরাজ (৬০) ব্যাটিংয়ে দলের হাল না ধরলে ৫০ ওভারে ১০ উইকেট হারিয়ে যে বাংলাদেশ ২২৬ রান করেছে, তাও করতে পারত না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসারদের নিয়ে যে ভীতি কাজ করেছে, তার সাফল্য তুলে নিল ক্যারিবিয়ানরা। ৮ বোলার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনই পেসার! তিন পেসার কিমো পল (৩/২০), চেমার হোল্ডার (২/৩৬) ও শামার স্প্রিঙ্গার (২/৩৬) মিলেই ৭ উইকেট তুলে নিলেন! জবাবে শিমরন হেটমায়ারের ৬০ রানের পর স্প্রিঙ্গারের অপরাজিত ৬২ রানের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৭ উইকেট হারিয়ে ৪৮.৪ ওভারে ২৩০ রান করে জয়ও তুলে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশকে আফসোসে পুড়িয়ে, হতাশায় ডুবিয়ে ফাইনালে খেলার টিকেট নিশ্চিত করে নিল ক্যারিবিয়ানরা। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হতেই সবার ভেতর একটা ভয় কাজ করেছে। রান যে স্কোরবোর্ডে কম হয়ে গেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার গিডরন পোপ যেভাবে প্রথম ওভারটিতে ব্যাটিং করলেন, মিরাজের করা ওভারের দ্বিতীয় বলে লং অফ দিয়ে ছক্কা, তৃতীয় বলে চার ও পঞ্চম বলে আরেকটি চার মারলেন; সেখানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠল। রানার করা চতুর্থ ওভারের প্রথম বলে পোপ পুল করতে গিয়ে যে শর্ট ফাইন লেগে বলটি আকাশে উঠালেন, সেই বলটি অনায়াসে ক্যাচ ধরার কথা থাকলেও শাওন তালুবন্দী করতে পারলেন না, সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতিও দেখা গেল। ফিল্ডিং যে নড়বড়ে তাও বোঝা গেল। এরপর একের পর এক ফিল্ডিং মিসও হয়েছে। তবে ৪৪ রানে গিয়ে ওপেনার টেভিন ইমলাচকে (১৪) ও ৫৬ রানে গিয়ে পোপকে (৩৮) আউট করে দিয়ে মিরাজ আশা জাগালেন। সেই আশায় আবারও মরীচীকা ধরার সম্ভাবনাই দেখা দিল। অধিনায়ক হেটমায়ার ও কিচি কার্টি মিলে যে অনায়াসে এগিয়ে যেতে থাকেন। দুইজন মিলে ৬২ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। ১১৮ রান ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই কার্টিকে (২২) বোল্ড করে দেন সালেহ আহমেদ শাওন। জুটি ভেঙ্গে দেন। কিন্তু অধিনায়ক হেটমায়ার চার-ছক্কার সঙ্গে একের পর এক রান স্কোরবোর্ডে যোগ করতে থাকেন। দলের স্কোরবোর্ডে যখন ১৪৭ রান যুক্ত হয়, এমন সময় গিয়ে কাজের কাজটি করেন সাইফুদ্দিন। অফসাইডে সেøা বল ছুড়েন। লোভ সামলাতে না পেরে হেটমায়ার লেগ দিয়ে আকাশে উড়িয়ে বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতে চান। কিন্তু সেøায়ার বল থাকায় ব্যাটে ঠিকমতো বল লাগেনি। সাইফের কাছে ক্যাচ যায় এবং দুর্দান্তভাবে ক্যাচ ধরেন সাইফ। হেটমায়ারের (৬০) আউটে যেন বাংলাদেশ প্রাণ ফিরে পায়। জেতার আশাও জেগে যায়! ১৬২ রানে আরেকটি উইকেট তুলে নেয়ার সুযোগ আসে। কিন্তু ১৫ রানে থাকা স্প্রিঙ্গারের রিটার্ন ক্যাচটি ধরতে ব্যর্থ হন সাইফুদ্দিন। এ ক্যাচটি ধরলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পুরোপুরি চাপে রাখা যেত। সেই চাপ ক্যারিবিয়ানদের ঘাড়ে সাইফুদ্দিন দিতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর শাওন দেন। ১৭৭ রানে জিড গুলিকে (৯) এলবিডব্লিউ করে দেন শাওন। ৭৮ বলে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জিততে ৫০ রান দরকার। হাতে থাকে ৬ উইকেট। শাওন ৩৮তম ওভারে বল করতে এসে দ্বিতীয় বলে গুলিকেতো আউট করলেনই, ওভারের পঞ্চম বলে কিমো পলকেও (৪) বোল্ড করে দিলেন। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু স্প্রিঙ্গার উইকেটে থাকাতে ভয়ই যুক্ত থাকে। এমন মুহূর্তে স্প্রিঙ্গারই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাঁচান। ২১৭ রানে মাইকেল ফ্রিউকে (১২) আউট করেন সাইফুদ্দিন। তখন জিততে ২৪ বলে ১০ রানের প্রয়োজন ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৭ উইকেটের পতন ঘটে। জিততে হলে অবিশ্বাস্য কিছু হওয়া চাই। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য কিছু হলোই না। ১২ বলে জিততে ৭ রানের দরকার থাকে। হাতে থাকে ৩ উইকেট। বল করতে আসেন সাইফুদ্দিন। প্রথম দুই বলে ২ রান হয়। পরের দুই বলে টানা দুটি বাউন্ডারি হাঁকান স্প্রিঙ্গার। যাকে নিয়ে ভয় ছিল, সেই স্প্রিঙ্গারই ঘাতক হয়ে ওঠেন। ম্যাচ জিতিয়ে দেন। ৮ বল বাকি থাকতেই জিতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৮৮ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ৬২ রান করে ম্যাচ জেতান স্প্রিঙ্গার। ম্যাচসেরাও হন। দলকে ফাইনালেও তোলেন। শাওন ৩ ও মিরাজ ২ উইকেট নেন। ১১৩ রানে যখন একটি দলের ৫ উইকেটের পতন ঘটে যায়, তখন সেই দলের ‘কোমড়’ ভেঙ্গেই যায়। সেখান থেকে বেশি দূর যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বেলাতেও তাই হয়। ওপেনাররা বরাবরের মতোই ব্যর্থ হন। পিনাক ঘোষ (০) ও সাইফ হাসান (১০) এদিনও অনুজ্জ্বলই থাকেন। ২৭ রানের মধ্যেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। এরপর জয়রাজ ৩৫ রান করতে পারলেও শান্ত ও জাকির দুইজনই ব্যর্থ হন। ১১৩ রানেই বাংলাদেশের ৫ উইকেটের পতন ঘটে যায়। এমন মুহূর্তে যে করেই হোক একজন ব্যাটসম্যানকে হাল ধরতেই হতো। তা ধরলেন আবারও অধিনায়ক মিরাজ। কিন্তু সাইফুদ্দিনের সঙ্গে ৮৫ রানের বেশি জুটি হলো না। ১৯৮ রানে গিয়ে মিরাজ নিজেই আউট হয়ে গেলেন। তবে সাজঘরে ফেরার আগে দলকে ৭৪ বলে ৭ চারে ৬০ রানের ইনিংস উপহার দেন। যা দলকে দুই শ’ রানের কাছে নিয়ে গেল। মিরাজ আউট হতেই সাইফুদ্দিনও (৩৬) সাজঘরে ফেরেন। পরপর দুই বলে মিরাজ ও সাইফুদ্দিনকে আউট করে দিলেন কিমো পল। এরপর মোসাব্বেক হোসেনের ১৪ ও মেহেদী হাসান রানার অপরাজিত ১০ রানে ২২৬ রান পর্যন্ত যেতে পারে বাংলাদেশ। তবে সব উইকেটই হারাতে হয়। এই রান যে সেমিফাইনালের মতো খেলায় বেশি নয়, তা অনুমিতই ছিল। প্রমাণও হলো তাই। হার হলো নিয়তি। ফাইনালে খেলার স্বপ্নও হলো ধূলিস্মাত।
×