ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মৃত্যুদ- বিলোপের আহ্বান;###;গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সাহায্য চাইলেন খালেদা

জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের প্রশংসায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের প্রশংসায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মৃত্যুদ- বিলোপের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল। এছাড়া তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এদিকে বাংলাদেশে কোন গণতন্ত্র নেই বলে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলকে অভিযোগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধি দল। বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও জাতীয় সংসদের স্পীকারের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের নেতা জিন ল্যাম্বার্টের সঙ্গে অপর তিন সদস্য এ বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধি দলকে জানান, সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনে বাংলাদেশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কোন প্রকার সন্ত্রাসী ও জঙ্গীগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ কখনই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না বলেও তাদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত গভীর হচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় পোশাক শিল্প খাতের শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রতিনিধি দল সরকারের নেয়া পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও পোশাক খাতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তঃযোগাযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলেও জানানো হয়। সার্ক, বিবিআইএন, বিমসটেক, বিসিআইএম ইত্যাদি ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমুদ্র সম্পদ খাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে এক বৈঠকে মৃত্যুদ- প্রথা বিলোপের জন্য আহ্বান জানান। তবে আইনমন্ত্রী প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে সব অপরাধের জন্য বর্তমানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে, সেই দ- বিলোপের সম্ভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যতে নতুন আইন করার ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে প্রাণদ- না রাখার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনাকালে মৃত্যুদ- নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন আমি স্পষ্টই বলেছি, যে সব অপরাধের জন্য বর্তমানে মৃত্যুদ- সাজা হিসেবে রয়েছে, সেগুলো কোন পরিবর্তন হবে না। তবে ভবিষ্যতে আমরা যখন নতুন আইন করব, আমরা চেষ্টা করব সেই নতুন আইনে; যেহেতু মৃত্যুদ- এখন সাজা হিসেবে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়, সেজন্য আমরা পরিবর্তন আনব। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিরোধী ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই শাস্তির বিলোপ ঘটানোর আহ্বান জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের দ- কার্যকরের সময়ও ইইউ বিবৃতি দিয়ে তা রদ করতে বলেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা কোন ঘটনার কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলেও তারা বাংলাদেশের আইনের সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদ- বিলোপের প্রসঙ্গ তোলেন বলে আইনমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, আজকের বাস্তবতা হচ্ছেÑ মৃত্যুদ- প্রাপ্ত কেউ যদি কোনমতে বাংলাদেশে বর্ডার ক্রস করতে পারেন এবং কোন পশ্চিমা দেশে যান। তাহলে আর কোনদিন তাকে ফিরিয়ে আনতে পারব না। কারণ তিনি কেবল দেখাবেন এইটায় যে বাংলাদেশে ফাঁসির আইন আছে, ফিরিয়ে দিলে ফাঁসি দিয়ে দেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের মধ্যে পলাতক কয়েকজনকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এ ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। সে কারণে বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যেসব ক্ষেত্রে এড়ানো সম্ভব, সেসব নতুন আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান না করার কথা বলেন আইনমন্ত্রী। যেমন ফরমালিনের আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- না রেখে যাবজ্জীবন রাখা ভাল। এ রকম আইন করলে আমরা সেখানে মৃত্যুদ- না রাখার চেষ্টা করব। তবে অপরাধের গুরুত্ব বুঝে যদি আমরা মনে করি, মৃত্যুদ- রাখাটাই অপরাধ দমনের সবচেয়ে ভাল অস্ত্র, তাহলে (নতুন আইনেও) মৃত্যুদ- থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়েও বৈঠকে কথা হয়েছে। তিনি ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের বলেছেন, সরকার নতুন ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট’ করে ৫৭ ধারার ‘বিভ্রান্তিগুলো’ দূর করার ব্যবস্থা করছে। তবে কিভাবে তা করা হবেÑ সে বিষয়ে কোন তথ্য আনিসুল হক দেননি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক ॥ ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটায় এ বৈঠক শুরু হয়। শেষ হয় বেলা সাড়ে পাঁচটায়। বৈঠকে বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। বৈঠককালে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে এখন কোন গণতন্ত্র নেই। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ঘটেছে। তিনি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা কামনা করেন। এছাড়া তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উত্তরোত্তর আরও জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। স্পীকারের সঙ্গে বৈঠক ॥ জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ সফররত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দল। বৃহস্পতিবার জিন ল্যামবার্টের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল স্পীকারের কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করে। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যুনও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠককালে স্পীকার প্রতিনিধি দলকে জানান, বাংলাদেশের সংবিধান ও সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশে সংসদীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রতি বুধবার সদস্যদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন। তাছাড়াও প্রতিদিন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। স্পীকার বলেন, সংসদীয় কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং মন্ত্রীর পরিবর্তে একজন সংসদ সদস্যকে কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়েছে। বৈঠককালে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আসন্ন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। তারা ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপ গঠন ও সংসদীয় প্রতিনিধি বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উল্লেখ্য, রাজনীতি, মানবাধিকার, পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে চার সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল তিন দিনের সফরে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকায় এসেছে। বুধবার সকাল থেকেই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি দলের চেয়ারপার্সন জিন ল্যাম্বার্টের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকা সফর করছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধি দলে রয়েছেনÑ যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সদস্য রিচার্ড হাউয়িট, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেট পার্টির সদস্য ইভান স্টিফেন্স ও কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য সাজ্জাদ করিম। আজ শুক্রবার প্রতিনিধি দল ঢাকা ত্যাগ করবে।
×