ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তোয়াব খানসহ এবার একুশে পদক পাচ্ছেন ১৬ জন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

তোয়াব খানসহ এবার একুশে পদক পাচ্ছেন ১৬ জন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাংবাদিকতায় গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান একুশে পদক পাচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় আরও ১৫ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একুশে পদক দিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বুধবার পদকপ্রাপ্তদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ডাঃ সাইদ হায়দার ও ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ একুশে পদক পাচ্ছেন। ভাষা সংগ্রামী সৈয়দ গোলাম কিবরিয়াও এবার মরণোত্তর এ পুরস্কার পাচ্ছেন। শিল্পকলায় এবার একুশে পদক পাচ্ছেন অভিনেত্রী জাহানারা আহমেদ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুরু প-িত অমরেশ রায় চৌধুরী, সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ, নৃত্যশিল্পী আমানুল হক। এ ছাড়া চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন মরণোত্তর একুশে পদক পাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এ বছর একুশে পদক পাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক। গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখায় অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ এবং মংছেন চিং মংছিন একুশে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ ও হাবীবুল্লাহ সিরাজী এবার একুশে পদক পাচ্ছেন। পদক বিজয়ী প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম স্বর্ণপদক এবং নগদ দুই লাখ করে টাকা দেয়া হবে। আশি পেরিয়ে সমান তালে সক্রিয় তোয়াব খান সুদীর্ঘ ৬০ বছর পেশাদার সাংবাদিকতার জগতে বিচরণ করছেন। বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের ইতিহাস গড়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। এখনও সেই পেশাদারিত্ব প্রতিক্ষণে ফুটে ওঠে দৈনিক জনকণ্ঠের পাতায় পাতায়। দেশের প্রথম চার রঙা রঙিন পত্রিকা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের ফিচার পাতায় বৈচিত্র্য এনেছেন যে মানুষটি মানুষ তিনি তোয়াব খান। এখন তার দেখানো পথেই হাঁটছে আধুনিক সংবাদপত্র। এখনও যে কোন তরুণ সংবাদকর্মীর চেয়ে বেশি কর্মঠ, নিতান্ত নির্মোহ মানুষটির দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই কাটে সাংবাদিকতাকে ঘিরে। দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকদের শীর্ষে তার অবস্থান। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নির্ভীক সাংবাদিক তোয়াব খান। সুশৃঙ্খল, নির্মোহ, সময়ের নিরিখের যথার্থ অগ্রসরমান, উদার, মুক্তচিন্তার অধিকারী তোয়াব খান। আজও তিনি তারুণ্যের শক্তি নিয়েই পেশাগত জীবনে ছুটে চলছেন অবিশ্রান্ত গতিতে। বৈচিত্র্যে ভরপুর তার সাংবাদিকতা জীবন। তোয়াব খান- যিনি শিশু বয়সেই দেখেছেন পঞ্চাশের মন্বন্তর, ব্রিটিশ শাসনের উগ্রতা, ’৪৭ সালের দেশ ভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতার মন্ত্রে জেগে ওঠার প্রয়াস, দেখেছেন পাকিস্তান সরকারের শাসন-শোষণের রোষানল, ’৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন- যুক্তফ্রন্টের বিজয়, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দাবিতে জেগে ওঠা স্বদেশ, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি ঘটনার ভেতরে শাণিত হয়েছে তার চেতনা, পেশা। সাংবাদিক তোয়াব খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে। পিতা আবদুল ওহাব খান, মা মোসাম্মৎ জোবেদা খানম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাদের বাড়িটি ছিল স্বদেশী আন্দোলনের একটি কেন্দ্রের মতো। পরিবারের অনেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ। সাতক্ষীরার শতাব্দী প্রাচীন প্রাণনাথ হাইস্কুলে (পিএন) তার শিক্ষা জীবনের শুরু। এই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর পড়াশোনা করেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় সমকালীন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করতেন। তবে ১৯৫৫ সালে প্রগতিশীল পত্রিকা সংবাদ-এ সাব-এডিটর হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। পত্রিকাটি ছিল তৎকালীন বামপন্থী নেতাকর্মীদের মত প্রকাশের একটি অভয়স্থল। মণি সিংহ, খোকা রায়, নেপাল নাগ, বারীন দত্ত, রণেশ দাস গুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ আলী এদের মতো নেতাদের সান্নিধ্য তোয়াব খানের জীবন ও চিন্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, এভাবেই অজান্তে হয়ে গেছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে গেছে জীবনের গতিপথও। এভাবেই অনেকটা ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া। তাতে ক্রমেই শিকেয় উঠেছে পড়াশোনা। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালেই তিনি তৎকালীন ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় যোগদেন চীফ সাব-এডিটর হিসেবে। ১৯৬৫ সালে তিনি দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার লেখা ও পাঠ করা ‘পিন্ডির প্রলাপ’ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি বাঙালীকে প্রেরণা যোগাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যোগ দেন দৈনিক বাংলায়-(অধুনালুপ্ত দৈনিক পাকিস্তান) ১৯৭২ সালে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে ট্রাস্ট পরিচালিত পত্রিকাটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রাষ্ট্রপতি সাহবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিব ছিলেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও মহাপরিচালক ছিলেন ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯২ সালে দৈনিক বাংলায় আবারও সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ যেন ছিল তার নিজের ঘরে ফেরা। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মৌলিক নীতির প্রশ্নে আপোস করতে না পারায় তৎকালীন সরকার তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করে। পরে যোগ দেন দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক পদে। সেই থেকে আজ অবধি তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত। এই পত্রিকার প্রতিটি পাতায় তার উদার পেশাদারী আধুনিক মনোভাবের বহির্প্রকাশ। ১৯৬২ সালে তোয়াব খান বিয়ে করেন। স্ত্রী হাজেরা খান। ২ কন্যার জনক তিনি। এর মধ্যে এক কন্যা এষা খান মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। অপর কন্যা তানিয়া খান আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে থাকেন। পেশায় শিক্ষক। তোয়াব খান বাংলা একাডেমি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য লাভ করেছেন বহু সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য কলাম সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল।’ আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি সুবল বিশ্বাস জানান, শিল্পকলায় (চিত্রকলা) মাদারীপুরের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন মরণোত্তর একুশে পদক পাওয়ার খবরে মাদারীপুরবাসী আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটি থেকে স্নাতকে উত্তীর্ণের পর থেকেই শিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন নানা বৈচিত্র্যময় ছবি এঁকেছেন। তিনি ছবির উপকরণ হিসেবে আঠা, গাছের পাতা, ছাল, মাছের কাঁটা, হাড়, টুকরা কাপড়, পথে পড়ে থাকা নানা উপকরণ ব্যবহার করতেন। আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সাড়া জাগানো ‘দি ফাদার’ ছবির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়কারী তৎকালীন ইউএনডিপির ঢাকার অফিসের এক কর্মকর্তা মার্কিন নাগরিক জন এডাম নেপিয়ার ওই সিনেমায় কাজী আনোয়ার হোসেনের বেশকিছু ছবি ব্যবহার করেন। আমেরিকায় ফেরার সময় তিনি শিল্পীর আঁকা বেশকিছু ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যান। ১৯৮৮ সালের বন্যার ছবি এঁকে একক চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। সেই ছবি বিক্রির টাকা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী ক্রয় করে বিতরণ এবং বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে দুর্গত মানুষদের সহায়তা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশে বিদেশে ২২টিরও বেশি একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তার ছবি। রক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরসহ দেশের অনেক আর্ট গ্যালারিতে। তার ছেলে কাজী আশিকুর হোসেন অপু জানান, তার বাবার ছবির বিশিষ্ট সংগ্রাহকদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, নেপালের রাজা, ফিলিস্তিনীর প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, যুগোসøাভিয়ার বিশ্ব নেতা মার্শাল টিটো, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। শিল্পীর ছেলে আরও জানান, স্বাধীনতার পর ভারতের প্রয়াত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে সফরে এলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পীর হাতে আঁকা একটি ছবি উপহার দেন। যা বর্তমানে নয়াদিল্লীর মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পীকে আদর করে নৌকা আনোয়ার বলে ডাকতেন। তার নির্দেশেই তিনি সারাজীবন নৌকার ছবি এঁকে গেছেন।
×