ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছে কিংব্যাক প্রয়াত মোনেম মুন্নার পরিবার?;###;জাহিদ রহমান

স্মৃতি অম্লান-হৃদয়ে সদা জাগরূক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

স্মৃতি অম্লান-হৃদয়ে সদা জাগরূক

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি কিংব্যাক খ্যাত ফুটবলার মোনেম মুন্নার একাদশতম মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু দীর্ঘ সময়কে জয় করা এই ফুটবলার ক্রীড়ামোদীদের হৃদয় থেকে একটুও বিস্মৃত হননি। ফুটবলমোদীদের কাছে এ নামটি এখনও অন্যরকম এক সৌন্দর্যের আভরণ। এখনও ক্রীড়ামোদীদের কাছে ফুটবলার মুন্না ভীষণরকম সমুজ্জ্বল এবং আত্মপ্রত্যয়ী এক নাম। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে কিংবদন্তি মুন্না সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে যান। এত অল্পবয়সে তাঁর চিরবিদায়ে ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছিল বিষাদের ছায়া। ২০০০ সালের প্রারম্ভে হঠাৎ করেই কিডনি ফেল করলে দ্রুত ডাক্তাররা কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। সেই মোতাবেক ঐ বছরের মার্চে ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় তাঁর শরীরে। মুন্নার বোন শামসুননাহার আইভী তাঁকে কিডনি দান করেন। এরপর টানা পাঁচ বছর ভাল থাকলেও ২০০৫ সালে মুন্না ফের ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে চিরকালের জন্য তিনি চলে যান। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নয়, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার এক সেরা ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, দক্ষ নেতৃত্ব এবং ফুটবলে দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ‘ফুটবল আইকনে’ পরিণত হয়েছিলেন। আর এ কারণেই ‘কিংব্যাকে’ উপাধি তার জন্য ছিল অবধারিত। আশির দশকের শেষ লগ্ন এবং নব্বই দশকজুড়ে এ দেশের ফুটবলাঙ্গন ছিল মুন্নাময় এতে কোন সন্দেহ নেই। ঢাকার মাঠের সবচেয়ে দামী ফুটবলারও ছিলেন মুন্না। তিনি যেমন নিজে খেলতেন তেমনি সতীর্থদের খেলাতেন। জাতীয় দল এবং আবাহনীকে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়ে একাই টেনে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। আবাহনীর সঙ্গে মুন্নার ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন এই ক্লাবের সঙ্গে। অনেকেরই হয়ত মনে হয়েছে নব্বই-এর গণঅভ্যুত্থানের পর একবার দেশের সেরা সব ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে নাম লেখালেও সে সময় মুন্না একাই আবাহনীতেই ছিলেন। এবং সে বছর মুন্না একাই একদল তরুণ ফুটবলারকে সঙ্গে নিয়ে আবাহনীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন। শুধু আবাহনীই নয়, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন ততদিন দেশের জন্যেও নিজেকে উজাড় করে খেলেছেন। সবসময়ই নিজের সর্বোচ্চটুকু দেশের জন্য দিতে সচেষ্ট থেকেছেন। ’৮০-’৮১ সালে পাইনিওর লীগে নাম লেখানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। পরের মৌসুম শান্তিনগরে খেলার পর মুন্না যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে। তার নৈপুণ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। বলা যায় এ সময়ই মুন্না কর্মকর্তাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ’৮৬ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবার নজর কাড়েন। এ সময়ই আবাহনী কর্মকর্তাদের নজরে পড়েন তিনি। পরের মৌসুমেই মুন্না যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। তখন আবাহনীর হয়ে খেলে যারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, খোরশেদ বাবুল, গাফফারসহ অন্যরা। তরুণ ফুটবলার মুন্না এসে এই অভিজ্ঞদের মাঝে নিজের জায়গা করে নেন। এরপর মুন্নাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যেখানেই মুন্না পা রেখেছেন সেখানেই সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। একটানা ’৯৭ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলেন তিনি। আবাহনীর হয়েই ফুটবলের বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে অবসরে যান। তবে ফুটবল খেলা ছাড়লেও মুন্না কর্মকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সহসাই। আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যু অবধি। সর্বশেষ আবাহনী মাঠেই তার শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মুন্নার খেলোয়াড়ী জীবন শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ছিল বড্ড আলোকময়। আবাহনীর হয়ে যেমন দাপটের সঙ্গে খেলেছেন তেমনি কলকাতা ফুটবল লীগেও টানা তিন বছর খেলে সমান দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ’৯১ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ নাইমুদ্দিনই প্রথম মুন্নাকে প্রস্তাব দিয়ে কলকাতা লীগে খেলার সুযোগ করে দেন। কলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মুন্না লিবেরো পজিশনে খেলে দারুণ আলোড়ন তোলেন এবং সহসাই বাংলাদেশের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জাতীয় দলের হয়ে মুন্না প্রথম খেলার সুযোগ পান ’৮৬ সালে। এ বছর সিউলে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের জন্য নির্বাচিত দলে তিনি প্রথমবারের মতো ডাক পান। তারপর দাপটের সঙ্গে খেলেন ’৯৭ সাল পর্যন্ত। ’৯৫ সালে তারই নেতৃত্বে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ কোন ট্রফি জেতার অনন্য কৃতিত্ব দেখায়। এই টুর্নামেন্টে মুন্নার একক পারফরমেন্স ছিল দেখার মতো। এ কথা সত্য যে, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন সেসময় ঢাকার মাঠে যত বড় স্ট্রাইকারের আবির্ভাবই ঘটুক না কেন মুন্নাকে সমীহ করতেই হয়েছে। মুন্নাকে ভেদ অথবা পরাস্ত করে জালে বল প্রবেশ করানোটা কোন স্ট্রাইকারের কাছেই সহজ কাজ ছিল না। আবার মুন্নার সময়ে বাংলাদেশে যত বিদেশী কোচ এসেছেন সবাই মুন্নার খেলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলার মুন্না যেন সবচেয়ে কাছের মানুষদের স্মৃতিপট থেকে মুছে যেতে শুরু করেছে। কেউ আর এখন মুন্না পরিবারের তেমন খোঁজখবর রাখেন বলে মনে হয় না। মুন্নার পরিবারও তাই খানিকটা আড়ালে আবডালে চলে গেছে বললে ভুল হবে না। তাঁর দুই সন্তান, স্ত্রী ইয়াসমিন সুরভীÑক্রীড়াঙ্গনের মানুষদের কাছে খানিকটা উপেক্ষিতই এখন। আসলে কেমন আছে কিংবদন্তি ফুটবলার মোনেম মুন্নার পরিবার? রাজধানীর রায়েরবাজারে মুন্নার রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে সন্তানদের নিয়ে নীরবে জীবনযাপন করছেন স্ত্রী সুরভী মুন্না। সুরভীর বাসায় কোন আভিজাত্য নেই। বাসাটা একেবারেই ছিমছাম। বাসাতে যতটুকু আভিজাত্য আছে তা হলো দেয়ালে সাজানো ফুটবলার মুন্নার বিভিন্ন ছবি আর খেলার মাঠ থেকে পাওয়া অজস্র পুরস্কার। এই আভিজাত্যটুকুর বাইরে আসলে আর কিছুই নেই। আর আছে দীর্ঘশ্বাস। পরিবারের মূল মানুষটি না থাকার কারণে সুরভী মুন্নাকে বছরের পর বছর স্ট্রাগল করতে হচ্ছে। মুন্নার মেয়ে এবং ছেলে এখন বেশ বড়। মেয়ে ইউসরা মুন্না বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। ছেলে আজমান এ লেভেল দিয়েছে। ইচ্ছে আছে ছেলেকেও বিদেশে পড়ানোর। ছেলে এবং মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করতে সুরভী মুন্না এখন চাকরি নিয়েছেন মিলেনিয়াম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি স্কুলে। সংসার আর স্কুলের চাকরি নিয়েই সময় কাটে তাঁর। কিন্তু অর্থনৈতিক চাপ সুরভী মুন্নাকে অনেকটাই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লেও তেমন কাউকে খুব একটা পাশে পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পারিবারিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেলেও সেভাবে কারো সহযোগিতা পাননি। তবে শুভাকাক্সক্ষীদের মাঝে আওয়ামী লীগ নেতা সাংসদ মৃণাল কান্তি দাসের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞ চিত্তেই স্মরণ করলেন। বললেন ‘দাদা’ আমাদের পাশে সবসময় আছেন। কিন্তু দাদা নিজেও এখন অসুস্থ। সুরভী মুন্নার অভিযোগের তীরটা বড় বেশি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের দিকে। অভিযোগের ব্যাখ্যায় বলেন, দেশের ফুটবলের জন্য মুন্না সবসময় নিবেদিত থেকেছে। কিন্তু সেই মুন্নার পরিবারের প্রতি কী দায়বদ্ধতা পালন করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন? মনে হচ্ছে মুন্নাকে তারা একদম ভুলে যেতে বসেছে। সুরভী মুন্না এমনিতেই ভীষণ চুপচাপ। মুন্নাকে হারানোর পর আরও বেশি চুপচাপ হয়ে যান। তবে হালে সেভাবে আর কেউ খবর না রাখায় সুরভী মুন্নার মাঝে কষ্ট আর অভিমানের শেষ নেই। যে মুন্নাকে রাস্তায় দেখলে হাজারো মানুষের ভিড় জমে যেত সেই জনপ্রিয় মুন্নাকে অগ্রজ আর অফিসিয়ালরা এভাবে ভুলে যাবেন সুরভী মুন্না ভেবে ভীষণ অবাক হন। অভিমান কণ্ঠে তাই বলেন, ‘মুন্না মারা যাওয়ার পর অনেকের অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেভাবে আর কেউ খোঁজখবর রাখেন না। মনে হচ্ছে দিন যতই যাচ্ছে ততই চারপাশের মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। মুন্নাকে হয়ত সেভাবে আর মনে রাখছে না কেউ। আর তাই অবহেলাটা বেশ চোখে পড়ছে। মুন্নার মৃত্যু দিনে আবাহনী ক্লাবেও এখন আর একটা মিলাদ পর্যন্ত হয় না। আরও অভিযোগ রয়েছে সুরভী মুন্নার। বললেন, ‘দেশের জন্য মুন্না জীবনবাজি রেখে খেলেছে। সবসময় সর্বোচ্চ শুধু নিজে দেয়নি, অন্য খেলোয়াড়দের দিতেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে খুব একটা মূল্যায়ন করা হলো না তাঁকে। কোথাও মুন্নার নামে সেই অর্থে কোন স্থাপনা বা স্মৃতিস্মারক করা হলো না। নারায়ণগঞ্জেও কিছু করা হলো না। বিএনপি আমলে ধানম-িতে একটি সেতুর নাম দেয়া হলো ‘মুন্না সেতু’ কিন্তু সেখানেও অবহেলা আর উপেক্ষা। মুন্নার নামের ওপর একটা কালো ছোপ পড়ে আছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। আবার ওখানে আজ পর্যন্ত মুন্নার একটা প্রতিকৃতিও স্থাপন করা হলো না যা দেখে এই প্রজন্ম উদ্বুব্ধ হবে। বুকে জমিয়ে রাখা অভিমান আর কষ্টের কথা বলতে সুরভী চান তিনি প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কিন্তু সে সুযোগও তিনি পাননি বলে অভিযোগ করলেন। পুরনো স্মৃতি মনে করে বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজ পর্যন্ত দেখা করার সুযোগ হলো না আমাদের। অথচ ব্যাঙ্গালোরে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের আগে আপা খিলগাঁও-এ মুন্নার বোন কামরুন আপার বাসায় এলেন মুন্নাকে দেখতে। মুন্নাকে আপন বোনের মতো আদর করে অভয় দিলেন। আমাদের সাহস জোগালেন। অনুপ্রেরণা দিলেন। অথচ আপার সঙ্গে আজ পর্যন্ত দেখা করার কোনো সুযোগ হলো না।’ সবশেষে সুরভী মুন্না বললেন, ‘মুন্না সবসময় বলত বাচ্চা দুটোকে খুব ভাল লেখাপড়া শেখাবে। বলত যে ওরা লন্ডন বা আমেরিকাতে লেখাপড়া করবে। মুন্নার সেই স্বপ্ন পূরণ করাটাই আমার অঙ্গীকার। আমি সেই স্বপ্নই কেবল দেখছি।’
×