ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঝুলে আছে ৩১ লাখ

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঝুলে আছে ৩১ লাখ

বিকাশ দত্ত ॥ খোদ রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় দীর্ঘ ২৬ বছর মামলা করে রায় পাবার পরও এম এ মোতালেব ফিরে পাননি তার জমি। ১৯৮৯ সালে ঢাকা সহকারী জজ আদালতে মামলা শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত আপীল বিভাগে গড়ায়। আপীল বিভাগ রায় পাবার পর বিবাদী পক্ষ তার জমি ফেরত দেয়নি। এ ঘটনায় আদালত অবমাননার মামলাও হয়। অনেকে মামলা জিতেও দখল গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের পুনরায় দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করতে হয়। এখন এম এ মোতালেব কি করবেন। এমন প্রশ্ন হাজারো মোতালেবের। একটি মামলা করে বাদী পক্ষ বছরের বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। মামলা করতে নিম্ন আদালতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। শুধু ব্যতিক্রম ঘটেছে শিশু রাজন, রাকিব হত্যা মামলার ক্ষেত্রে। এ মামলায় বিচার দ্রুততম সময়ে শেষ হলেও দেশের উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৩১ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এক দিকে বিচারক সঙ্কট অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীদের নানা ভোগান্তির ফলে দিন দিন মামলা জট বেঁধে যাচ্ছে। পুরনো মামলা নিষ্পত্তি হলেও তুলনামূলকভাবে নতুন মামলা জট সৃষ্টি করছে। উচ্চ আদালতসহ আইনকমিশন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও মামলা জট কোনভাবেই রোখা যাচ্ছে না। মামলা জটের ফলে বিচারকসহ বিচারপ্রার্থীরা নানা সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন। গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগসহ সকল জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭৪টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে আপীল বিভাগে ১২ হাজার ৪৬২টি, হাইকোর্ট বিভাগে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩১০টি, দেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৪টি এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএম এম/সিজেএম) ৯ লাখ ৩৯ হাজার ২৮টি। এদিকে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আগের তুলনায় মামলা জট কমতে শুরু করেছে। আমাদের নজর দিতে হবে নতুন যে মামলা হচ্ছে তার চেয়ে যাতে বেশি করে নিষ্পত্তি হয়। সেদিকেই বেশি নজর দিতে হবে। কিছু কিছু মামলা অনেক দিন পড়ে ছিল। ট্রাফিক ভায়োলেন্স মামলাগুলো সিএমএম কোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। আমরা কিন্ত এগিয়ে যাচ্ছি। সহিংসতার কারণে নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। সে কারণেই আবার মামলা বেশি হচ্ছে। সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের মূল সমস্যা বের করে সমাধান করতে হবে। তা না হলে যেখানে আছি সেখানে থেকে যাব। নতুন নতুন বিচারক নিয়োগ করে কোনভাবেই সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আইনজীবীদের অভিমত, পদ্ধতিগত কারণে মামলা দীর্ঘ জটযুক্ত হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিগত কারণে মামলা জট বেড়ে যাচ্ছে। কারণে অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষদের মতে নোটিস জারি হয় বছরের পন বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হবার কারণে পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিস জারি হয়ে ফেরৎ আসায় পরে ভুল নথিতে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। এ কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হতেই দীর্ঘবিলম্ব হয়। পুনরায মামলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদালতের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনিবার্য হলেও তা করা হয় না। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায সেকশনে চলে যায়। নতুন করে তালিকা অন্তভুক্ত করতে শুনানি অন্তে দীর্ঘ সময় নেগে যায়। ফলে শুধুমাত্র আইনজীবীদের অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়। সিলেটের শিশু রাজন আর খুলনার রাকিবকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা নাড়া দেয় গোটা দেশকে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে সবাই। গণমাধ্যমের শীর্ষ খবর হয়ে ওঠা হত্যা দুটির বিচার কাজ শেষ হয় নিম্ন আদালতে। আর সিলেটে শিশু সাঈদ হত্যার বিচার কাজ শেষ হয় মাত্র ৮ কার্য দিবসে, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত শেষ হওয়া মামলা বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। যদিও এ মামলার ২৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পেয়েছেন আসামিরা। অথচ দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যার প্রায় ৩১ লাখ। এই ৩১ লাখ মামলার বিপরীতে উচ্চ আদালতে ১০২ জন বিচারপতি আর নিম্ন আদালতে ১৫০০ বিচারক রয়েছেন। আইন কমিশনের মতে মামলা জট নিরসনে নতুন বিচারপতি ও বিচারক নিয়োগ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। আইন কমিশনের মতে নিম্ন আদালতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে ৩ হাজার নতুন বিচারক নিয়োগ করা অতি প্রয়োজন। মামলা জট নিরসনে কিভাবে করা যায় এ প্রসঙ্গে আইনজীবীরা বলেছেন, ‘মামলার জট কমাতে হলে যে ধরনের বিচারক বা আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে তাদের প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করতে হবে। আর এই প্রশিক্ষণ ২ থেকে ৩ মাস অন্তর অন্তর পুনরায় করাতে হবে।’ এ ছাড়া এখনও একটি বিচারের বিষয়কে প্রতিপক্ষের কাছে নোটিস পাঠাতে কোন কোন ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ বছর পরও প্রতিপক্ষ নোটিস পান না। এ ছাড়া মামলার এ ভার কমাতে বিচার সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার কোন কমতি নেই জানিয়ে জট কমাতে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরলেন কিছু আইনজীবী। তাদের মতে, বিচারকরা অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আদালতের অভাব, বিচারকের অভাব তার মধ্যে দিয়েও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। হাইকোর্টে বিচারপতির পাশাপাশি মামলার পরিসংখ্যান ॥ উচ্চ আদালতে পাহাড়সম মামলা বিচারাধীন থাকলেও বর্তমান আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টে প্রধানবিচারপতিসহ মোট ১০২ জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে হাইকোর্টে ৯৬ জন এবং আপীল বিভাগে ৬ জন। ৭ ফেব্রুয়ারি আপীল বিভাগে আরও তিন জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে নতুন বিচারপতি নিয়ে আপীল বিভাগে বিচারপতির দাঁড়াল ৯জন। বর্তমানে আপীল বিভাগে আরও ২ জন বিচারপতির পদ শূন্য রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হাইকোর্টে এক জন বিচারপতির হাতে গড়ে ১৪০০ এবং নিম্ন আদালতে এক জন বিচারকের হাতে গড়ে ৩১০০টি মামলা থাকে। কোনভাবেই একজন বিচারপতির পক্ষে নিষ্পত্তি করা সম্ভবপর নয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টের বিচারপতি ও মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০১ সালে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ছিল ৫৬ জন, তার বিপরিতে মামলা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ২৮০টি। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৫৫ আর মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৯টি, ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৫৭ জন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ১৬৮টি, ২০০৪ সালে বিচারপতির সংখ্যা ৭২ আর মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪৭টি, ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৭২ জন আর মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮১১টি, ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৬৯ জন আর মামলার সংখ্যা ২লাখ ৮ হাজার ৩৮৯টি, ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৬৫ জন আর মামলার সংখ্যা ২লাখ ৪০ হাজার ৪৭৯টি, ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৬৭ জন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৬২ হাজার ৩৪৫টি, ২০০৯ সালে ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৭৮ মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি, ২০১০ সালে ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৯৪ জন আর মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি, ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৯৫ জন মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫টি, ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ১০১ জন আর মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি, ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৯৫ জন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৩১টি, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৯০ জন আর মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৬টি এবং ২০১৫ সালের ১জানুয়ারি বিচারপতির সংখ্যা ৯৭ জন আর মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৮টি। একনজরে উচ্চ আদালতের মামলা ॥ উল্লেখ্য, জনসংখ্যার পাশাপাশি মামলাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় নিষ্পত্তি কম হচ্ছে। যার ফলে প্রতিদিন নতুন করে জটে যুক্ত হচ্ছে মামলা। এর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উচ্চ আদালতে (আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগ) বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭২টি। এর মধ্যে আপীল বিভাগে (দেওয়ানী ও ফৌজদারি) মোট ১২ হাজার ৪৬২টি অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগে তিন মাসে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপীল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৩৪৬টি। আর হাইকোর্ট বিভাগে ছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ৩৮টি। সূত্র মতে ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল ২লাখ ৬২ হাজার ৩৪৫টি। পরের বছর ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২লাখ ৯৩হাজার ৯০১টি। ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টিতে। এর মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১লাখ ৯৯ হাজার, দেওয়ানী ৮০ হাজার ২৮৮টি। ২০০৮ সালে হাইকোর্টে দায়ের হয় ৫২ হাজার ৫৯০টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানী মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৭২৮টি। এবং ফৌজদারী মামলার সংখ্যা ৪৫ হাজর ৮৬২টি। ২০০৯ সালে নতুন মামলা জমা হয় ৫২ হাজার ৪৮৮টি। এর মধ্যে দেওয়ানী ৭ হাজার ৩২টি। রিট ও ফৌজদারী মামলার সংখ্যা ৪৫ হাজার ৪৫৬টি।
×