ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধান আসামি নূর হোসেন, লে. কর্নেল সাঈদ ও র‌্যাবের আরও দুই সাবেক কর্মকর্তাসহ ২৩ জনের আদালতে হাজিরা ;###;২৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ

নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের দুই মামলায় ৩৫ আসামি ॥ অভিযোগ গঠন

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের দুই মামলায় ৩৫ আসামি ॥ অভিযোগ গঠন

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ সারা দেশে আলোচিত নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় দায়ের করা দুটি মামলায় প্রধান আসামি নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। আসামি ২৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য তারিখ ধার্য করেছে আদালত। অপর আদালতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৩টি চাঁদাবাজির মামলায় নূর হোসেনের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য দুটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে মাদক ও দেশীয় অস্ত্রের তিনটি মামলায় জামিন পেয়েছেন নূর হোসেন। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অপর তিনটি মামলায় জামিন আবেদন না মঞ্জুর করেছেন আদালত। অন্যদিকে ৭ খুনের একটি মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা ও ন্যায় বিচার দাবি করে তিনি মামলার সাক্ষী ও তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সোমবার সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ৭ খুনের মামলার আসামি নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) তারেক সাঈদ, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম এম রানাসহ ২৩ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্রভুক্ত ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ আসামিদের উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ গঠনের দিন পেছানো, পরবর্তী মামলার তিন মাস পর, আদালতে আসামিদের দেয়া ফৌজদারি কার্য বিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দী প্রত্যাহার, অভিযোগপত্র থেকে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন জানালে আদালত তা নাকচ করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন অভিযোগপত্রভুক্ত ৩৫ আসামি প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনান। পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো প্রধান আসামি নূর হোসেনকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি আপনার চিরশত্রু প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে খুন করার জন্য অন্যান্য আসামির সঙ্গে পরিকল্পনা করে ৭ জনকে খুন করিয়েছেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদকে উদ্দেশ করে পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, আপনার নির্দেশে ৭ জনকে অপহরণ করে খুন করা হয়েছে, আরিফ হোসেনকে বলেন, আপনার নেতৃত্বে ৭ জনকে অপহরণের পর খুন করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, এম এম রানাকে উদ্দেশ করে বলেন, ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় আপনি জড়িত। একইভাবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপর আসামিদের হত্যাকা-ে কার কি ভূমিকা ছিল হত্যাকা-ে কে কীভাবে জড়িত ছিল সেসব অভিযোগ তুলে ধরেন পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন। এ সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ২৩ আসামি তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন এবং আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। একটানা তিন ঘণ্টা আদালত উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে আসামি পক্ষের জামিন ও অভিযোগ গঠন পেছানোর আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠন করেন এবং আসামি ২৫ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন। পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন সাংবাদিকদের বলেন, কাঠগড়ায় উপস্থিত মামলার ২৩ আসামির মধ্যে নূর হোসেন এবং মিজানুর রহমান দীপু ছাড়া বাকি ২১ আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। ২০জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীসহ অপহরণ ও হত্যাকাজে ব্যবহৃত গাড়ি, বস্তা, ইট, পলিথিন ও দড়ি কাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তাদেরসহ এই মামলায় ১২৭ জন সাক্ষী পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করেছেন। এ সব বিষয়য়ে আদালতে উপস্থাপনের পর আদালত ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলায়ই ৩৬৪/৩০২/২০১/১০৯/১১৪/৩৪ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১২০ এর খ ধারা সংযুক্ত করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ৭ খুনের দুটি মামলার মধ্যে একটি মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী জেলা আইনজীবী এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, দেশব্যাপী আলোচিত ৭ খুনের দুটি মামলায় শুনানি শেষে আদালত অভিযোগ গঠন করেছেন। আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতির আবেদন জানালে আমরা তার বিরোধিতা করেছি। আগামী ধার্য্য তারিখে আমরা আদালতে এই মামলার সাক্ষীদের উপস্থাপন করতে পারব। একটি মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, এই হত্যাকা-ের ঘটনায় খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা ও ন্যায়বিচার চাই। যেহেতু এই মামলাটির বিচারকার্য শুরু হয়েছে আমরা আমাদের সাক্ষীদের নিরাপত্তা চাই। আমরা আমাদের নিরাপত্তা চাই। ফাঁসি থেকে বাঁচার জন্য নূর হোসেন ও তার লোকজন মিছিল-মিটিং করছে। তারা আদালত প্রাঙ্গণে শত শত ক্যাডার বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছে। আমাদের নূর হোসেনের লোকজন নানাভাবে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে সাক্ষী ও আমাদের নিরাপত্তা চাই। র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেনের আইনজীবী এম এ রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, সাত খুনের এই মামলায় তদন্তে অনেক গাফিলতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এই মামলার আসামি যারা পাবলিক সার্ভেন্ট ছিল তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত বা বিচার করতে হলে সরকারের কাছ থেকে কোন অনুমতি বিধান থাকলেও তা করা হয়নি। এই মোকদ্দমায় অভিযোগ গঠনের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৭টি ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই বিষয়টি আদৌ আইনানুগ নয়। একজন আসামিদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ২৩৪ ধারার বিধান মতে তিনটি ধারার অতিরিক্ত কোন ধারায় অভিযুক্ত করা যায়নি। আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। আদালতে এ সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছি। আদালত আমাদের বক্তব্য আমলে না নিয়ে অভিযোগ গঠন করেছেন। আসামি পক্ষ উচ্চ আদালতে গেলে প্রতিকার পাবে। নূর হোসেনের সহযোগী মিজানুর রহমান দিপু, মোহাম্মদ আলী, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী আহম্মদ ও রহম আলীর পক্ষের আইনজীবী আশরাফুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আমি আমার মক্কেলদের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলাম। আমার আসামিরা নির্দোষ তারা কোন বাহিনীর সদস্য নয়, তারা একেবারেই সাধারণ মানুষ, নূর হোসেনের সঙ্গে তাদের কাজকর্ম ছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার অভিযোগপত্র কোনভাবেই গ্রহণ বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আদালত আমাদের নাকচ করে অভিযোগ গঠন করেছে। এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জের ৩টি চাঁদাবাজির মামলায় সকাল ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ৭ খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের হাজির করে জামিন আবেদন জানালে শুনানি শেষে আদালত তা না মঞ্জুর করেন। এর মধ্যে দুটি মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অপর মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম ফজলুর রহমান জানান, ৭ খুন ছাড়া মাদক, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ মোট ৬টি মামলার মধ্যে মাদক ও ধারালো অস্ত্রের ৩টি মামলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন নূর হোসেন। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অপর তিনটি মামলায় জামিন আবেদন না মঞ্জুর করেছেন আদালত। আদালতে হাজির করা ২৩ আসামিকে ॥ নূর হোসেন, লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম এম রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরগুজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, ল্যান্স কর্পোরাল রহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, হাবিলদার (বিজিবি) নাছির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, নূর হোসেনের সহযোগী মর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু ওরফে মিজান, রহম আলী, আবুল বাশার। এখনও ১২ আসামি পলাতক ॥ আদালতে অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে নূর হোসেন ছাড়া এখনও পলাতক ১২ জন এখনও আসামি গ্রেফতার হয়নি। চার্জশীটভুক্ত এখনও পলাতক আসামিরা হলো-অবসরপ্রাপ্ত র‌্যাব সদস্য কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলিম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন শরিফ, তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, নূর হোসেনের সহযোগী মোঃ সেলিম, সানা উল্লাহ ছানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকা থেকে প্যানেল মেয়র ও ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীর ও চন্দন সরকারের গাড়ি চালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুল ও চন্দন সরকারসহ ৬ জন ও ১ মে সিরাজুল ইসলাম লিটনের জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল দীর্ঘ প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওসি মামুনুর রশিদ ম-ল নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭ খুনের ঘটনায় নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম এম রানাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
×