ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(৮ ফেব্রুয়ারির পর) জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কীভাবে সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করে ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন এবং তার ফল কী হয়েছিল মইনুলের বিবরণে তার একটা চিত্র আমরা পাই। জেনারেল শফিউল্লাহর সময় মইনুলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি লিখেছেন- “আর্মি শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য বিষয় দেখে অত্যন্ত বিচলিত হই এবং আর্মিতে ঐক্যের মারাত্মক অভাব অনুভব করি। অধিনায়কগণ আর্মির শৃঙ্খলা ও অন্য আইনকানুনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে আমার মনে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব তো ছিলই, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কোন্দল, দলাদলি ও পারস্পরিক রেষারেষিতে লিপ্ত ছিলেন।” [পৃ. ৬৯] জেনারেল জিয়ার উল্টোদিকের বাসায় থাকতেন তিনি। একদিন জিয়ার বাসা থেকে বেরুবার সময় দেখেন, মেজর ফারুক সেখানে দাঁড়িয়ে। সেখানে তিনি কী করছেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, তিনি জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। জিয়াকে পরদিন মইনুল ফারুকের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, ফারুক এসেছিল এবং তিনি তার স্টাফদের জানিয়েছেন জুনিয়র অফিসারদের তার বাসায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে। মেজর রশীদও একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং ফটকের সামনেই সেনাবাহিনী, রাজনীতি, বাকশাল নিয়ে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে থাকলে তিনি নিয়মানুযায়ী তা তার কমান্ডারকে জানাতে বলেন। অর্থাৎ এ চক্রটি সময় নিয়েই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় মইনুল অসুস্থ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও মুজিব মইনুলের স্ত্রীর কাছে তার খোঁজ-খবর নেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ১২ আগস্ট বাসায় ফেরেন। ১৫ তারিখ সকালে জিয়া তাকে ফোনে জানান, ‘শেখ মুজিব হ্যাজবিন কিল্ড’ এবং তাড়াতাড়ি তাকে সদর দপ্তরে যেতে বলেছেন। তিনি তৈরি হতে হতেই জেনারেল রব ও চা বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোতাহারউদ্দিন গাড়িতে করে তার বাসায় উপস্থিত হয়ে জানান তারা তাকে নিয়ে জেনারেল ওসমানীর বাসায় যেতে চান যাতে ওসামানীকে খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখা যায়। মইনুল জানালেন, সেটি বোধহয় সম্ভব হবে না। কারণ, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকেই ওসমানী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। এ কথা শোনার পর তারা দুজন চলে যান। মইনুল রওনা হন সদর দপ্তরের পথে। ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলের সঙ্গে তার দেখা হয়। মইনুল জিজ্ঞেস করেন, মুজিব হত্যায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়ার কথা তিনি ভেবেছেন? শাফায়াত জওয়াব দেন তাদের কয়েকজন তার সঙ্গে সকালে দেখা করেছেন এবং এখন “তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গেলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে।” এ উত্তর শুনে মইনুল অবাক হন। জামিলের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে খানিকটা ভিন্ন। মইনুল জানাচ্ছেন, অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ফাইল এলে তা নাকচ করে দেন। কারণ ১২ ডিসেম্বর ফারুক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মইনুলের ভাষায়, এটি ছিল ‘জঘন্য কলঙ্কময়’ যার নজির বিরল, কিন্তু সদর দপ্তরে বিদ্রোহ দমনের উদ্যোগ ছিল না। মোশতাক এসে ‘জয়বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রচলন করলেন। এই দুটি শব্দ পরিবর্তনই বুঝিয়ে দিল, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পূর্বতন আদর্শের পরিবর্তন হয়েছে। ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হলো। এরশাদকে মেজর জেনারেল। আরও কিছু পরিবর্তন হলো এবং মইনুল জানাচ্ছেন এসব পরিবর্তন ওসমানী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা করেছিলেন। জিয়া সেনাপ্রধান হলেন এবং “মুজিব হত্যায় জড়িত অফিসার ও অন্যান্যকে আয়ত্তে আনার জন্য কোনোরূপ সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে অপারগ ছিলেন।” সম্ভবত তিনি নিজের অবস্থান যথোপযুক্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন। [পৃ. ৮১] অন্যদিকে সিজিএস খালেদ মোশাররফ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। কারণ তার সঙ্গে জিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। আবার ওসমানী জিয়াকে পছন্দ করতেন না। এরই মধ্যে জিয়াকে বন্দি করা হয় তার বাসায়। বেগম জিয়া তাকে খবরটি জানান। দ্রুত তিনি সব বাধা উপেক্ষা করে জিয়ার বাসায় আসেন। খুব অবাক হন জিয়া। তিনি জিয়া ও তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে চলে আসেন। নানা নাটকের পর জিয়ার ইস্তফা আদায় করা হয় এবং খালেদ সেনাপ্রধান হন। শহরজুড়ে জানানো হয় খালেদ ভারতের ‘এজেন্ট’। এ গুজব খুব কার্যকর হয়েছিল। খালেদ নিহত হন। এসব ঘটনা সবার জানা। মইনুল লিখেছেন, “এ অভ্যুত্থানে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না এবং এই অভ্যুত্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তাদের কোনো বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভ্যুত্থানকারী সিনিয়র অফিসারদের চিন্তাধারা সম্যক অবগত ছিলাম। এটা নিছক কাকতালীয় এবং সম্পূর্ণভাবে আর্মির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেনাবাহিনীতে ও দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, এটা ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের পক্ষে অভ্যুত্থান। আর এটাই পরে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।” [পৃ. ৯০] অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান ইত্যাদির পর পরিস্থিতি ক্রমে শান্ত হয়। মইনুল অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে হত্যাকারী ও বিভিন্ন অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিচারের জন্য বলেন কিন্তু জিয়া “এতে উৎসাহী ছিলেন না।” [পৃ. ৯৭] বরং তাকে লন্ডন দূতাবাসে কাউন্সিলর করে পাঠানো হয়। লন্ডনে তিনি লক্ষ্য করেন, “জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় স্বার্থরক্ষা করার চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে।” [পৃ. ৯৯] মাসকারেনহাস সম্পর্কে জানান, তিনি লন্ডনের সোনালী ব্যাংক থেকে ২০ হাজার পাউন্ড ঋণ নেন যা শোধ করেননি এবং “তাকে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ওপর মহলের নির্দেশে ওই অর্থ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে।” [পৃ. ১০০] মইনুল তা পছন্দ করেননি ফলে মাসকারেনহাসের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইঙ্গিত করেছেন এ কারণেই মাসকারেনহাস জিয়াকে হেয় করে ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ লেখেন। ১৯৭৫-এ মুজিবের ছবি সংবলিত বিভিন্ন মানের ‘কোটি কোটি’ টাকা পোড়ানো হয়। এগুলো লন্ডনে ছাপাতে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া মওদুদ ও জাকারিয়া খানকে তখন লন্ডনে পাঠানো হয় জিয়ার জন্য রাজনৈতিক “প্ল্যাটফর্ম ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য।” [পৃ. ১০০] ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে জিয়া মইনুলকে ঢাকায় আসতে বলেন। মইনুল তার বাসায় দেখা করেন। পরে একদিন অফিসেও। সেখানে জেনারেল এরশাদও ছিলেন। মইনুলের জায়গায় লন্ডনে কাকে পাঠানো যায়? জিয়ার এ প্রশ্নের উত্তরে মইনুল কর্নেল সাবিউদ্দিনের নাম করেন। এরশাদ তখনই বলেন, ‘হি ইজ নট আওয়ার ম্যান’। এটি শুনে মইনুল হতবাক হয়ে এর প্রতিবাদ করেন। জিয়া তারপর তাদের থামিয়ে দেন। মইনুল লিখেছেন, “সেনাবাহিনীর অবস্থা তখনও ছিল বিশৃঙ্খল। নতুন অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নূরুল ইসলাম জিয়ার রাজনৈতিক কাজ ও দল গঠন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনিই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণে উদ্যোগ নেন। মইনুল জিয়াকে বলেছিলেন এ প্রস্তাব নাকচ করতে। তিনি করেননি। পরে এরশাদ আমলে ও বেগম জিয়ার আমলে তিনি যখন ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে রাষ্ট্রদূত তখন খুনিদের সেসব জায়গায় পাঠানোর চেষ্টা হলে তিনি তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।” মইনুল আরো উল্লেখ করেছেন জেনারেল শওকত ও মনজুরের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। জিয়ার বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে এটি স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরিকল্পনা তিনি জানতেন, এতে প্রশ্রয়ও দিয়েছিলেন। বিনিময়ে খুনিদের যত রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া যায় দিয়েছিলেন। ১৭. সবশেষে আমি আনোয়ার উল আলমের বইয়ের কথা উল্লেখ করব। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন না, ছিলেন রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে তারও ভূমিকা ছিল। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তার গ্রন্থ রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা। এই গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে ১৫ আগস্টের কথা বিবৃত হয়েছে। তিনি যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলেন না সেহেতু ধরে নিতে পারি, তার লেখা হবে অনেক অবজেকটিভ। বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় রক্ষীবাহিনীপ্রধান নুরুজ্জামান ছিলেন দেশের বাইরে। আবুল হোসেন ছিলেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। আনোয়ার আর সরোয়ার ছিলেন উপ-পরিচালক। ১৫ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে আনোয়ার ফিরে আসেন বাসায়। সকালে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধুর ফোনে। তিনি বলেন, ‘শহীদ, মনির [শেখ মনি] বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখো তো কী করা যায়?’ এ কথা বলে তিনি ফোন রেখে দেন। এরপর তোফায়েল আহমেদও ফোন করে একই কথা বলেন। চলবে...
×