ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষায় দলবাজি

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শিক্ষায় দলবাজি

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ শনিবার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির পঞ্চম সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে দেশের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আলোচনার দাবি রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য কেবল ডিগ্রী অর্জন নয়, চাকরি বা কর্মজীবনে ভাল উপার্জন নয়, প্রকৃত অর্থে একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হওয়াই এর লক্ষ্য। সেই অর্থে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে কোন জঙ্গীবাদী বা মৌলবাদী কর্মকা-ে জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষকম-লী সর্বোপরি অভিভাবক শ্রেণী সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে সে অবস্থায় নেই। এমনকি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে একদা খ্যাত ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই সুখ্যাতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’জন শিক্ষার্থীকে নানা অনৈতিক কার্যক্রমসহ জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে আজীবনের জন্য। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এহেন অবস্থার সূচনা একদিনে হয়নি। সত্যি বলতে কি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যেদিন থেকে সরকারী হস্তক্ষেপ তথা রাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়, সেদিন থেকেই শুরু হয় শিক্ষার মানের ক্রমবনতি। সত্য বটে, এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজেরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাদের রাজনৈতিক মত ও সমর্থন নিতান্তই নিজ নিজ পরিম-লে সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষক সমিতি থাকলেও তা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেনদরবারের মধ্যেই সীমিত ছিল। অনুরূপ ছিল ছাত্র সংসদগুলো-শিক্ষার্থীদের অধিকার তথা স্বার্থরক্ষা করাই ছিল তাদের কাজ। তবে শীঘ্রই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন-তখন সরকারী হস্তক্ষেপ শুরু হয়। আর শিক্ষকরাও সেই সুযোগ নিয়ে সাময়িক লাভ ও পদ-পদবীর আশায় শুরু করেন ক্ষমতাসীন সরকার ও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি। ছাত্র সংগঠনগুলোও জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বাতাবরণে। তবে স্বভাবতই যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের সমর্থক শিক্ষকম-লী ও ছাত্র সংগঠন দলে-বলে-শক্তিতে প্রায় একচ্ছত্র ও বলীয়ান হয়ে ওঠে। নিছক দলীয় বিবেচনায় মেধা ও যোগ্যতা আদৌ আমলে না নিয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগও এর অন্যতম। এর বিষময় ফল কী হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নীতি-নৈতিকতাসহ আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা দূরে থাক, শিক্ষার মান পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। দলীয়করণের এমনই অপার মহিমা! তবে সময় বুঝি এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারী তথা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। সর্বাগ্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়। অতীতে সামরিক সরকারের আমলে যেভাবে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সূচনা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে তা শোভা পায় না। শিক্ষকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিও কাম্য নয়। লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে ছাত্র সংগঠনগুলোকেও। উচ্চশিক্ষাসহ যাবতীয় শিক্ষাঙ্গন হবে শুধুই বিদ্যাচর্চা, শিক্ষালাভ ও জ্ঞানার্জনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্র। শিক্ষায় দলবাজি বন্ধ হলেই কেবল তা অর্জন সম্ভব হতে পারে।
×