ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নওগাঁয় বন্ধ চালকলের নামেও বরাদ্দ

চাল সংগ্রহে ব্যাপক দুর্নীতি

প্রকাশিত: ০৭:১২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চাল সংগ্রহে ব্যাপক দুর্নীতি

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ মহাদেবপুর উপজেলায় সরকারীভাবে আমন চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চালকল মালিক সমিতির নেতাদের যোগসাজশে পরিত্যক্ত ও বন্ধ চালকলের সঙ্গে চুক্তি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া উপজেলার তিনটি এলএসডি গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি-এলএসডি) বিরুদ্ধে বস্তাপ্রতি ৩৫ টাকা করে, অর্থাৎ প্রতিটনে ৭শ’ টাকা করে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিকেজি ৩২ টাকা দরে উপজেলার মহাদেবপুর, মাতাজী ও মহিষবাথান খাদ্য গুদামে এ বছর ৪ হাজার ৩৮৫ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ লক্ষ্যে উপজেলার ৩৭৩টি অটোমেটিক ও হাস্কিং মিল মালিকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী চলমান চালকল, আলাদা চাতাল, আলাদা বিদ্যুত সংযোগ, ধান সিদ্ধ করার হাউস, বয়লার ও গুদামঘর আছে কিনা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তা যাচাই-বাছাই করে মিলারদের সঙ্গে চুক্তি করার কথা। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এমন ৪০-৫০টি চালকলে গিয়ে সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অটোমেটিক রাইস মিলগুলো চালু থাকলেও অধিকাংশ হাস্কিং মিলই বন্ধ রয়েছে। আমন মৌসুমে বরাদ্দ পেয়েছে এমন চালকলের মধ্যে এচাহাক চালকল, রেখা চালকল, সাপাহার চাউল কল, আশরাফিয়া চালকল, ম-ল চালকল, শোভনা চালকল, দছির উদ্দিন চালকল, অনন্যা বর্ষা চালকল, আল আমিন এ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিজ, আরাফাহ রাইস মিল, হাজী রাইস মিল, ইসলাম চালকল, সরদার রাইস মিল, সৌরভ চালকল ও তরফদার রাইস মিল সরেজমিনে গিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। এসব চালকলের মধ্যে কোন কোনটির তিন থেকে চার বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আবার কোন কোন বয়লারের গুদামঘরে রীতিমতো মুরগির খামার করা হয়েছে। উপজেলার মাতাজী ইউনিয়নের রঘুনাথপুর এলাকায় সরদার রাইস মিল দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বলে এর মালিক তাহের উদ্দীন সরদার জানান। এর পরও মালিক সমিতির নেতাদের ধরে খাদ্য বিভাগ থেকে আমনের বরাদ্দ পাওয়ায় কোন রকম ব্যবসায় টিকে আছেন তিনি। অটো-বয়লার থেকে চাল কিনে খাদ্য গুদামে সাড়ে ৭ টন চাল দিয়েছেন। উপজেলার সারতা এলাকায় ইসলাম চালকলে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় ধান সিদ্ধ না করার চাতালে ঘাস জন্মে গেছে। ধান শুকানোর চাতালের একটি অংশে বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে ঘর করে এবং চাল রাখার গুদাম ঘরটি মুরগির খামার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জানতে চাইলে এর মালিক নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী জুলেখা খাতুন অকপটে স্বীকার করেন আমন মৌসুমে সাড়ে ৭ টন চাল সরবরাহের বরাদ্দ পেয়েছে। নুরুল ইসলাম বলেন, এর জন্য মাতাজী খাদ্য গুদামের ওসি এলএসডিকে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩৫ টাকা করে উৎকোচ দিতে হয়েছে। একই এলাকায় অবস্থিত হাজি রাইস মিলে গিয়ে দেখা যায়, মিলটি চালানোর জন্য যে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে সেই বিদ্যুত সংযোগ ব্যবহার করে বোরো আবাদে সেচের জন্য পাম্প বসানো হয়েছে। ৭-৮ বছর ধরে মিলটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অথচ খাদ্য বিভাগের বরাদ্দ বিভাজন কাগজে এই মিলের নামও রয়েছে। ভীমপুর ই্উনিয়নের সরস্বতীপুর এলাকার চাল কলের মালিক নুর মোহাম্মদ জানান, ব্যবসা চালাতে না পেরে মিলের গুদাম ঘর ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। বাজার থেকে চাল কিনে সরকারী খাদ্য গুদামে বরাদ্দের চাল দিতে হয়েছে। মহাদেবপুর খাদ্য গুদামে বরাদ্দের চাল দেয়ার জন্য তাকে প্রতি বস্তায় ৩৫ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে বলেও তিনি জানান। উপজেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি আতোয়ার রহমান বলেন, আমরা মিলারদের প্রতিনিধি হিসেবে সার্বিকভাবে উৎপাদনক্ষম এমন মিল বরাদ্দ দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছি। ছাড়পত্র দেয়ার আগে মিলগুলো উৎপাদনক্ষম কিনা সেটি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের। মহাদেবপুর সদর খাদ্য গুদামের ভারপাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস যেভাবে মিলপ্রতি বরাদ্দ দিয়েছে সেভাবেই চাল গ্রহণ করছি। কোন্টি বন্ধ মিল সেটি আমার জানা নেই। এটা জানার কথা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের। উৎকোচের বিষয়ে তিনি বলেন, খাদ্যনিয়ন্ত্রক অফিস নিলে নিতে পারে। মহিষবাথান খাদ্য গুদামের ভারপাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে যে বরাদ্দ বিভাজন পেয়েছি সে মোতাবেক প্রতি মিলারের কাছ থেকে চাল নিচ্ছি। বন্ধ চাতাল, চালকল থেকে কিভাবে চাল ক্রয় করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটি দেখার দায়িত্ব উপজেলা খাদ্য পরিদর্শকের। তার প্রত্যয়নেই আমরা চাল সংগ্রহ করি। বছরের পর বছর বন্ধ চালকলকে কিভাবে প্রত্যয়ন দিলেন, এ বিষয়ে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক সোহেল বলেন, মিল মালিকরা চাল খাদ্য- গোডাউনে নিয়ে এলে তাদের চালের কোয়ালিটি দেখে আমি প্রত্যয়ন দিয়েছি। টাকার বিনিময়ে বন্ধ চালকলকে প্রত্যয়ন দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দেননি। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ পার্সেন্ট মিল বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে, তার পরও তাদের কিভাবে বরাদ্দ প্রদান করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, আসলে ছোটখাটো মিলে আমন মৌসুমে অল্প বরাদ্দ আর এ চাল ভাঙ্গাতে তারা লেবার পান না এবং খরচও বেশি পরে, তাই তারা বাইরে থেকে চাল ক্রয় করে দেয়।
×