ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

কলা চাষের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কলা চাষের কথা

ছেলেবেলায় মুরুব্বিদের সঙ্গে কয়েকবার শীত মৌসুমে আমাদের এলাকার কাছের নদী ডাকাতিয়াতে মাছের পোনা সংগ্রহ করার জন্য নৌকা করে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম সাত সকালে আটিয়া কলা খেয়ে জেলেরা নদীতে পোনা ধরতে নামতেন। বলা হয়েছিল আটিয়া কলা শীতে তাদের শরীরকে গরম রাখে। এর পরে গ্রাম থেকে ঢাকায় কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জে স্টিমার ঘাটে স্টিমার থামার সঙ্গে সঙ্গে সাগর কলা নিয়ে বিক্রির জন্য অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা স্টিমারকে ঘিরে ফেলতে দেখেছি। মুন্সীগঞ্জের সাগর কলা যেমনি পুষ্ট তেমনি মিষ্টি বলে দেখেছি ও অনুভব করেছি। আরও পরে কর্মজীবনে দেখেছি যে সাগর কলা উৎপাদনের মূল কেন্দ্র মুন্সীগঞ্জ থেকে নরসিংদী এবং তার পরে বগুড়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। আমাদের এলাকায় এই সময়ে সবরি কলার উৎপাদন বা লভ্যতা তেমন চোখে আসেনি। আনাজ কলার উৎপাদন ও লভ্যতা অবশ্য দেশের সব এলাকায়ই প্রত্যক্ষ করেছি। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন এলাকায় একটি নামকরা ভারতীয় বিভাগীয় বিপণিতে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে কাঁচা-পাকা কলার সঙ্গে সঙ্গে কলার পাতা, মোচা এমনকি আলকা বা কলা গাছের শাঁস বিক্রি হতে দেখেছি। বিক্রেতা বলেছেন খাওয়ার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসবের প্রয়োজন অভিবাসী ভারতীয় ও চীনাদের মধ্যে বিদ্যমান। আমরা এ দেশে এখন পর্যন্ত কলার পাতা, মোচা এবং আলকা বা শাঁসকে তেমন বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে মনে করি না। অধুনা ঢাকায় কিছু কিছু বিভাগীয় বিপণিতে কলার মোচা এবং আলকা বিক্রয়ের জন্য মজুত রাখা শুরু হয়েছে। কয়েক যুগ আগ পর্যন্ত কলার পাতায় কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন দেখেছি। কলার পাতা অবশ্য দেশের উন্নয়নের এই পর্যায়ে তেমনভাবে ব্যবহৃত হয় না। কলার পাতা, কলা গাছের ডাল ও আলকার আচ্ছাদন শুকিয়ে এখনও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কলার খোসা উত্তম পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। পাকা কলা ভেজে সংরক্ষণ করাও স্থানবিশেষে নজরে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশে কলা চাষ ও বিপণন বিষয়ক তথ্যাদি সম্পর্কে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমায় বেশ কৌতূহলী করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশে কলা চাষের ওপর একটি জরিপলব্ধ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই কৌতূহল অনেকাংশে মিটিয়েছে। দেশের ১১৮টি অপ্রধান ফসলের মধ্যে কলা অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে কলা এই দেশের উৎপাদিত সকল ফলের মধ্যে প্রধান। এই প্রেক্ষিতে এই জরিপে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তাদি নীতি নির্ধারকদের জন্য কলা চাষের বিস্তারণে গুরুত্বপূর্ণ ও বিবেচনীয় উপকরণ। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫টি পার্বত্য জেলা যথা :চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়িকে ১ ভাগে নিয়ে বাকি ৫৯টি সমতল ভূমির জেলাকে ২য় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে গৃহস্থালি প্রতি ন্যূনপক্ষে ৫ শতাংশ জমি কলা চাষে প্রযুক্তকৃত খামারগুলো ২০১৩ সালে দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপ করা হয়। পরিসংখ্যানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এভাবে পরিচালিত দৈবচয়ন ভিত্তিতে সম্পাদিত জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তাদি সারাদেশে কলা চাষের প্রকৃতি অনুধাবন ও তার উন্নয়নে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যবহার্য বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের কৃষি পরিসংখ্যানের বর্ষপুস্তকের প্রাক্কলন আনুযায়ী দেশে মোটা দাগে ১৩০০০০ একর জমিতে কলা উৎপাদনের খামার বিদ্যমান। ২০০৭-২০০৮ সালে কলা উৎপাদনের খামার আবৃত জমির পরিমাণ ২০০৬-২০০৭ সালের ১৪৫০০০ একর থেকে ১৩১০০০ একরে নেমে গিয়েছিল বলে বিদিত হয়েছে। ২০১১-২০১২ সালে এই সব খামারে আবৃত জমির পরিমাণ আরও নিচে- ১২২০০০ একরে- নেমে এসেছিল। এভাবে নেমে আসার কারণ ঝড়ের বিপর্যস্ততা এবং ক্রমান্বয়ে চাষযোগ্য ভূমিতে বাসগৃহ ও শিল্পের প্রসার বলে ধারণা করা যায়। ন্যূনপক্ষে ৫ শতাংশ আয়তনবিশিষ্ট কলার খামারে কলার বাণিজ্যিক উৎপাদন হয় বলে ধরা হয়। এছাড়া গৃহস্থালির কোনাকানা বা সংলগ্ন পতিত জমিতে খোরপোষের জন্য কলা উৎপাদিত হয়। খোরপোষে উৎপাদিত কলার জন্য ব্যবহৃত সর্বমোট জমি সম্ভবত বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কলার চাষে প্রযুক্ত সর্বমোট জমির সমপরিমাণ। এই ধারণায় বাংলাদেশে মোট দাগে ২৬০০০০ একর জমিতে কলা চাষ হয় বলে ধরে নেয়া যায়। (চলবে) লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×