ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন;###;রহমান শোয়েব

গ্র্যাজুয়েটদের আনন্দময় দিন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

গ্র্যাজুয়েটদের আনন্দময় দিন

এমনটা যে হবে তা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। সাবেকরা যে দিনটিকে কোনভাবেই অন্যদের হতে দেবে না তা ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ শুধু এক হাজার বা দুই হাজার নয়। পুরো সাত হাজারেরও বেশি সাবেক মিলিত হয়েছিল সেদিন। তাই বর্তমানরাও যেন আনন্দের সঙ্গেই দিনটিকে সঁপে দিয়েছে সাবেকদের কাছে। উৎসবের শুরু ২৯ জানুয়ারি। দলে দলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা ছুটছেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে। কারণ তারা খবর পেয়েছিলেন সেখানেই পাওয়া যাবে স্বপ্নের সেই পোশাক। সমাবর্তন গাউন, যা গায়ে চাপিয়ে ফটো সেশনে মেতে ওঠার স্বপ্ন বহুদিনের। তাই ৩১ জানুয়ারি সমাবর্তনের দিন হলেও দেরি করতে চাননি অনেকেই। আগে ভাগেই হাজির হয়েছেন স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে। ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারেননি সাবেকদের স্রোতের ঢেউ। তবে ৩০ জানুয়ারি শনিবারেই তা বোঝা গেল। দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর সমাবর্তন হওয়ায় কেউ যেন এক সেকেন্ডও নষ্ট করতে চান না। তাই আগেভাগেই হাজির হয়েছেন প্রাণের ক্যাম্পাসে। উদ্দেশ্য সমাবর্তন গাউন সংগ্রহ করে ফটোসেশনে মেতে ওঠা। একের পর এক পোচ দেয়া ক্যামেরার সামনে। যেন ক্যাম্পাসের এক ইঞ্চি স্থানও ক্যামেরার ফোকাস থেকে বাদ না পড়ে। পুরো ক্যাম্পাসকে ক্যামেরায় বন্দী করে নিয়ে যেতে চান সবাই। কারণ সবাই এখন কর্মব্যস্ত। জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ। এই যুদ্ধেও হতে হবে কৃতকার্য। তাই বলে তো আর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো যে ক্যাম্পাসে পার করে আসা তা ভোলা যাবে না। তাই এ যেন ক্যামেরার লেন্সে স্মৃতির খাতায় বাড়তি কিছু পৃষ্ঠা যোগ করার প্রয়াস। প্রিয় ক্যাম্পাসকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অবিরাম চেষ্টা। শনিবার থেকেই শুরু দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো, সেলফি তোলা, আড্ডা, গানে মজে থাকা। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার, চাকসু, জারুলতলা, গ্রন্থাগার, জাদুঘর, হতাশার মোড়, ঝুলন্ত সেতু, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি, ফরেস্ট্রি, জিরো পয়েন্ট কোন স্থানই বাদ যায়নি। সবখানেই সাবেকদের পদধূলি পড়েছে। অনেকেই প্রিয় শ্রেণী কক্ষের সামনে গিয়ে ঘুরে এসেছেন। ছুঁয়ে দেখেছেন শ্রেণীকক্ষের দরজা-জানালা। আবেগে, ভালবাসায় চোখের পানিও ফেলেছেন কেউ কেউ। মনের ক্যানভাসে বারবার ভেসে ভেসে উঠতে থাকে, ‘ওই বেঞ্চটাতেই তো আমি বেশি বসতাম। ওখানেই আমারসহ বন্ধুদের নাম লিখেছিলাম বড় বড় করে মার্কার দিয়ে। তা কি আজও আছে?’ আছে হয়ত। ভাবতেই গলা কেমন যেন ভারি হয়ে আসে। চোখ ঝাপসা ওয়ে ওঠে। ‘আমার সেই বন্ধুটি কেমন আছে? আসবে কি সমাবর্তনে? কত দিন দেখি না!’ অনেকেই আবার গিয়েছেন নিজ হলের সেই কক্ষটিতে। যেখানে নিজে থেকেছেন। চবির ঝুপড়িগুলোতে যখন আড্ডা বসল তখন যেন তারুণ্য বাঁধ ভেঙ্গেছে। গলা ফাটিয়ে, টেবিল চাপড়ে গানের সুর উঠল আকাশে। একের পর এক সেই ‘ঝুপড়ি সং’গুলো সুর তুলল বহুদিন শান না দেয়া জং ধরা কণ্ঠে। তাই শুরুতে কিছুটা বেসুরো মনে হচ্ছিল। তবে মুহূর্তেই সেই সুরের ধার ফিরে এলো। আর যেন গান থামতেই চায় না। থামবে কিভাবে? কিছুক্ষণ পরপরই যে গানের দলে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। বন্ধুদের খোঁজ পেতে দেরি হলেও চলে আসতে দেরি হচ্ছে না কারও। এই তো সেদিন, ক্লাস শেষে দলবেঁধে ঝুপড়িগুলোতে চায়ের কাপে ঝড় তুলতেন সবাই। গানের সুরে কখন যে বেলা পড়ে যেত টেরই পাওয়া যেত না। আজ যেন সেই দিনগুলোই হাজির করতে চান তারা। কত দিন পর দেখা হচ্ছে কারও কারও সঙ্গে! তাই জড়িয়ে ধরেও যেন আবেগ থামতে চান না। চোখের জলে সে আবেগ গড়িয়ে পড়ে। একে অপরের খোঁজখবর নিয়েছেন। অনেকেই এসেছেন সস্ত্রীক। আবার অনেকে একা। তা নিয়ে বন্ধুদের খুনসুটি চলতে থাকে চলন্ত রেল গাড়ির মতো। জীবনযুদ্ধের নানান অভিজ্ঞতা শেয়ার হতে থাকে। তেমনই একজন গ্র্যাজুয়েট দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। তিনি জানান, ‘বহুদিন পর বন্ধুদের পেয়ে যেন ছাত্র জীবনের সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছি। কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র ক্লাস শেষ করে বন্ধুরা মিলিত হয়েছি। কিছুক্ষণ পরই পরবর্তী ক্লাসের জন্য দলবেঁধে ছুটে যাব।’ সাবেকদের কাছে পেয়ে চবির প্রকৃতিও যেন উচ্ছ্বসিত। নিজেকে রাঙ্গিয়েছে নানা রঙে। ধুলো বালির পুরু আস্তর নেই ভবনগুলোর গায়ে। সড়কগুলোও নিজের ভাঙ্গা শরীরের ক্ষত ঘোচাবার চেষ্টা করেছে যথাসাধ্য। যাতে সাবেকদের কষ্ট না হয়। গাছপালাগুলোতেও লেগেছে রঙের ছোঁয়া। মোড়ে মোড়ে আলোকসজ্জা যেন বলে বেড়ায় ‘আজ আর ঘুমাবার দরকার নেই, আমার রাতের রূপ দেখবে না দলবেঁধে?’ আর প্রকৃতিকে নিরাশ না করে দলবেঁধে ঘোরাফেরাও করেছে সাবেকরা। অবশেষে আসে রবিবার, ৩১ জানুয়ারি। চবির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সমাবর্তনের দিন। সকাল থেকেই সাবেকদের স্রোত গিয়ে ঠেকে চবি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। কারণ সেখানেই গ্র্যাজুয়েটদের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা জানানোর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। যাদের আগেভাগে আসার সৌভাগ্য হয়নি, তারা আইন অনুষদ সংলগ্ন বুথসমূহ থেকে সংগ্রহ করেন গাউন। আর সঙ্গে সঙ্গেই মেতে ওঠেন আনন্দ উল্লাসে। হ্যাট উড়িয়ে হইহুল্লোর করে মুহূর্তগুলোকে আটকে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা চলতে থাকে আনাড়ি ফটোগ্রাফারদের। কেউ ক্যামেরার সামনে ঠিকমতো পোচ দিতে না পারলেও সব দোষ ফটোগ্রাফারের। আবার ছবি ঠিক না হলেও দোষ ফটোগ্রাফারের। আসলে সব দোষ বন্ধুদের। এভাবেই বন্ধুদের ওপর দোষ চাপিয়ে হইহুল্লোর চলতে থাকে। সাবেকদের পদভারে ধুলো রঙিন হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসের আকাশ বাতাস। বেলা দু’টার দিকে গ্র্যাজুয়েটরা প্রবেশ করেন অনুষ্ঠানস্থলে। রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মোঃ আবদুল হামিদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া মাত্র শুরু হয়ে যায় গ্র্যাজুয়েটদের ডিগ্রী প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা মুহূর্তের জন্য গ্র্যাজুয়েটদের বাস্তবতায় নামিয়ে আনে। তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দায়িত্বের কথা। সে দায়িত্ব পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি। চবি উপাচার্য তার ভাষণে বলেন, ‘আজ যে সনদ তুলে দেয়া হলো সেটি আসলে দায়িত্ব- দায়িত্বই তাকে অর্পণ করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে।’ উপাচার্যের বক্তব্যে কিছুটা ভাবগাম্ভীর্যতা সৃষ্টি হলেও পরক্ষণেই তা কেটে যায় যখন রাষ্ট্রপতি গ্র্যাজুয়েটদের ডিগ্রী প্রদান ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত হওয়া মাত্রই হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠেন গ্র্যাজুয়েটরা। তেমনি একজন পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রেজাউল হক রুবেল। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তির বিষয়টি যে কতটা আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মনে হচ্ছে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। ঘোর কেটে গেলেই সব হারিয়ে যাবে।’ দিন শেষে ফেরার পালা। বোঝাই গেল, এই মুহূর্তটা কারও কাম্য ছিল না। তবু নিয়তিকে মেনে নিতেই হবে। তবে অশ্রুকে আড়াল করে হাসিমুখেই বিদায় নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা সকলের। দলবেঁধে শাটলে উঠতেই সেই পুরনো স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠল। শাটল ট্রেনের বগিগুলো তখন একগাদা গ্র্যাজুয়েটে ঠাসা। যারা কিছুদিন আগেও শাটলে গলা ফাটিয়ে গান করেছেন। তবে কি আজও তেমন হবে। নিশ্চয়। এ যে চবির সংস্কৃতি। অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আছে এমন? শুরু হয়ে যায় বগিতে গানের উৎসব। পুরনো দিনের গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক, ফোকÑ কোন গানই বাদ গেল না। সব শেষে সম্মিলিত কণ্ঠে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো ...’ গানের মাধ্যমে।
×