ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিযোগ পেলে আইনী ব্যবস্থা

সোর্সরাই পুলিশকে অপরাধে নামাচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সোর্সরাই পুলিশকে অপরাধে নামাচ্ছে!

শংকর কুমার দে ॥ বেপরোয়া পুলিশ সোর্স। নিজেরা তো অপরাধে জড়াচ্ছেই, পুলিশ সদস্যদের অপরাধে জড়ানোতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে তারা। অপরাধে জড়ানোর কৌশল হচ্ছে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রলোভনের টোপ। পুলিশ সোর্সরা স্বীকৃত কোন সোর্স নয়। তাদের কারও কাছে কোন জবাবদিহিতাও নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সোর্স মানি পায় না তারা। চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়, হয়রানি করে যে পুলিশ সদস্য যে বখরা পায় তার ভাগবাটোয়ারার একটি অংশ পায় পুলিশ সোর্স। পুলিশ সোর্সদের এলাকাভেদে তাদের অনেক সাঙ্কেতিক নাম। কোন এলাকায় নাম তাদের ‘ফর্মা’, কোন এলাকায় ‘টিকটিকি’ ইত্যাদি। সাঙ্কেতিক নাম শুনেই অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যায়। রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন চায়ের দোকানি বাবুল মাতুব্বর হত্যাকা-ের দায়ে ওসি প্রত্যাহার ও চার পুলিশ প্রত্যাহার, মামলা দায়ের, তদন্ত কমিটি গঠনসহ যে হৈচৈ হয়ে গেল তার নেপথ্যেও রয়ে গেছে পুলিশ সোর্সরাই। রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় পুলিশ সোর্সদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে। পুলিশের তদন্ত কমিটি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন চায়ের দোকানি বাবুল মাতুব্বরকে ইয়াবা- মাদক ব্যবসায়ী অভিহিত করে পুলিশের দুই সোর্স দেলোয়ার হোসেন ও আইয়ুব আলী। পুলিশের রিকুইজিশন করা একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে গাড়ি থেকে নামেন এই দুই পুলিশ সোর্স। এই দুই পুলিশ সোর্সই বাবুল মাতুব্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে তার কাছে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে শাহ আলী থানার পুলিশকে ক্ষেপিয়ে তুলে আটক করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। তখন বুধবার রাত প্রায় নয়টা। পুলিশ সদস্যরা বাবুল মাতুব্বরকে টহল গাড়িতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে। নিরূপায় হয়ে দোকানের খুঁটি ধরে বসেন চায়ের দোকানি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ কেরোসিনের স্টোভে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। স্টোভটি ছিটকে বাবুলের গায়ে গিয়ে পড়ে। এতে মারাত্মক দগ্ধ হন চায়ের দোকানি। মারাত্মক দগ্ধ বাবুল চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান। চায়ের দোকানি বাবুল মাতব্বুর হত্যাকান্ডের নেপথ্যের ঘটনা পাওয়া গেছে পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্তে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৯ থানার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ সোর্সদের এ ধরনের অপরাধের অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে। এসব অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। পুলিশের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ, চাঁদাবাজি, বখরা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধী কার্যক্রম চালাচ্ছে পুলিশ সোর্সরা। যেই পুলিশ সোর্সরা অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করবে সেই তারাই এখন অপরাধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধী কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের ঘটনায় পুলিশ সোর্সদের মদদ যোগাচ্ছে এক শ্রেণীর অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে জমা পড়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, পুলিশ সোর্সরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথের দোকান থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল নিয়ে মধ্যস্থতা, এমনকি কাঁচামালের আড়ত থেকেও চাঁদাবাজি করছে। অনেক সময়ে তারা নিজেদের পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সোর্সরা পরিচয় দিচ্ছে থানার ওসির ক্যাশিয়ার। আসামিদের পক্ষ নিয়ে পুলিশের নাম পরিচয় ব্যবহার করে বাদীকে হুমকি দেয়। আবার অনেক সোর্স কোন ব্যক্তিকে আটক করে থানায় আনলে মোটা অঙ্কের টাকা মিলবে- এমন তথ্যও পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যদের দিচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের সোর্সদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। এলাকায় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, যাত্রাবাড়ী মোড়, যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত, সবজির আড়তসহ বিবিরবাগিচার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশের সোর্সরা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করে। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে থানার পুলিশ সোর্স দেলু, কাশেম ও খোকন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে প্রায় ১২শ’ দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন পুলিশের নামে ১০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের একজন ভুক্তভোগী মৎস্য ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, পুলিশ সোর্সদের কাজ প্রতিদিন ভোরে মাছের আড়তে এসে থানার নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকার ফুটপাথ, পরিবহন, মাদক স্পট থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি, তোলাবাজি আদায়ের নেপথ্যে রয়েছে থানার অঘোষিত ও আত্মস্বীকৃত ক্যাশিয়ার ও পুলিশের সোর্সরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশ সোর্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। যখনই অভিযোগ পাওয়া গেছে তখনই তদন্তপূর্বক সত্যতা পাওয়ার পর আইনী ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে যেসব অপরাধীদের শনাক্ত করে অপরাধ উদ্ঘাটনে তদন্তে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন এলাকায় সোর্স ব্যবহার করেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ সোর্সদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগভাবেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
×