ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিশির বইমেলা -মীম নোশিন নাওয়াল খান

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

তিশির বইমেলা    -মীম নোশিন নাওয়াল খান

তিশির আজ মহানন্দ। বাবা তাকে বইমেলায় নিয়ে এসেছেন। বইমেলা সম্পর্কে তিশির খুব একটা ধারণা ছিল না। এখন ধারণা হচ্ছে। বাবা তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছেন। দুইপাশে শুধু মানুষের ঢল। তিশি একবার জিজ্ঞেস করল, বই কোথায় বাবা? শুধু তো মানুষ আর মানুষ! বাবা হেসে বললেন, আমরা এখনও মেলায় ঢুকিনি মা। মেলার ভেতরে বই আছে। তিশি অবাক হলো। এটা মেলা না? তাহলে এখানে এত মানুষ কেন? আবার রাস্তার দু’পাশে খেলনা, স্যান্ডেল, গয়না-এটা সেটা বিক্রি হচ্ছে। মেলা তো এমনই হয়। এর আগে সে যখন বৈশাখী মেলায় গিয়েছিল, তখন এমনই দেখেছে। সে ভেবেছিল বইমেলাও এমন হবে। ঝুড়িতে করে মানুষ বই বিক্রি করবে। কিন্তু এখন দেখছে বিষয়টা মোটেও তা নয়। ঝুড়িতে অন্য সব জিনিস বিক্রি হচ্ছে, বই না। ফুটপাথে অবশ্য কেউ কেউ বই নিয়ে বসে আছে, কিন্তু বাবা বলেছেন ওদের কাছ থেকে বই কিনতে হয় না। আসল মেলা ভেতরে। ভিড় ঠেলে তিশিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন বাবা। উপরের দিকে তাকিয়ে তাকে বললেন, এই যে দেখো, এটা হচ্ছে বইমেলা। তিশি চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক তাকাল। অনেক বইয়ের দোকান। যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু বইয়ের দোকান। সেখানে বই আর বই। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এবার বুঝছে বইমেলা কেমন? তিশি মাথা ঝাঁকাল। তারপর বিস্ময় নিয়ে বলল, বইমেলায় এত এত বইয়ের দোকান বাবা? বাবা বললেন, হ্যাঁ তো। এগুলোকে বইয়ের স্টল বলে। এখানে তুমি সব রকম বই পাবে। তিশি জিজ্ঞেস করল, অনেক রঙ্গিন ছবিওয়ালা বই পাব? বাবা বললেন, হ্যাঁ। কেন পাবে না? তিশিকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটা জায়গায় এসে বললেন, এই যে, এটা হচ্ছে শিশু কর্ণার। এখানে শুধু ছোটদের বই পাওয়া যায়। এখানে তুমি তোমার পছন্দের বই পাবে। তিশিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে তার হাত ধরলেন তিনি। বললেন, এবার তুমি বই পছন্দ কর। তিশি বিস্ময়ভরা চোখে সবকিছু দেখতে লাগল। এই জায়গাটায় তার সমান, তার চেয়ে ছোট, বড় অনেকেই বাবা-মায়ের হাত ধরে এসেছে। তারা স্টলগুলোতে বই দেখছে। কারও কারও হাতে বইয়ের প্যাকেট। এখানে আরও মজার জিনিস আছে। কার্টুনের ছবি বড় করে কেটে বিভিন্ন জায়গায় রেখে দেয়া আছে। তিশির জায়গাটা বেশ পছন্দ হলো। সে বাবার হাত ধরে পায়ে পায়ে একটা বইয়ের স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা বললেন, তুমি এখান থেকে বই দেখো। খুলে দেখো, কোন বইটা পছন্দ হয়। তিশি কাঁপা হাতে একটা বই নিল। বইটা খুলেই তার মন আনন্দে নেচে উঠল। বইয়ের ভেতর কী সুন্দর সুন্দর ছবি! আর বইটা থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ বেরুচ্ছে! তিশি বলল, আমি এই বইটা নেব বাবা। বাবা হাসলেন। বললেন, আচ্ছা, নিও। কিন্তু আগে আরও বই দেখ। দেখবে, অন্য কোন বই হয়ত এটার চেয়েও বেশি ভাল লাগবে। তিশি জানে এই বইটা তার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগবে। এরচেয়ে সুন্দর আর কোন বই হতেই পারে না! এটায় যা সুন্দর সুন্দর ছবি! তবুও সে আরও কিছু বই দেখল। অবাক হয়ে দেখল, প্রতিটা বই-ই খুব সুন্দর। সবই তার পছন্দ হয়ে গেল। বাবা এই কথা শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, বলেছিলাম না তোমাকে? তিশি অনেক বই কিনে ফেলল। তারপর বলল, বইমেলা এত বড় বাবা? বাবা বললেন, হ্যাঁ। তবে বইমেলা কিন্তু এত বড় ছিল না। ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা নামে একজন বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় ৩২টি বই সাজিয়ে নিয়ে বসেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। তারপর আস্তে আস্তে তার সঙ্গে অন্যরাও যোগ দেয়। এরপর বাংলা একাডেমি বইমেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই বইমেলা এত বড় হয়ে যায়। তিশি চোখ বড় বড় করে বাবার কথা শুনল। বলল, তার মানে বইমেলা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে? বাবা বললেন, হ্যাঁ। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে। এরপর বাংলা একাডেমি এই মেলার আয়োজন শুরু করে। প্রতিবছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে মেলা হয়। তোমাকে তো আমি ভাষা আন্দোলনের গল্প বলেছি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর জন্য, যেন এই ভাষায় আমরা কথা বলতে পারি সেজন্য ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন রফিক-শফিক-সালাম-বরকত-জব্বার। সেই ভাষা শহীদদের সম্মান জানিয়ে এবং ভাষা আন্দোলনকে মনে করেই বইমেলার নাম দেয়া হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই কারণেই মেলাটা ফেব্রুয়ারি মাসে হয়। তিশির চোখে পানি এসে গেল। সে বলল, ওঁরা কত ভাল ছিল, তাই না বাবা? আমরা যেন বাংলায় কথা বলতে পারি, সেজন্য ওঁরা জীবন দিয়েছে! বাবা বললেন, হ্যাঁ মা। এই জন্য ভাষা শহীদদের কখনও ভুলতে নেই। সবসময় তাঁদের সম্মানের সঙ্গে মনে করবে। তিশি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ বাবা। তারপর একটু ভেবে বলল, বাবা, আমি ঠিক করেছি বড় হয়ে লেখক হব। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এই কথা মনে হলো কেন? তিশি খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, লেখক হয়ে আমি ভাষা শহীদদের নিয়ে বই লিখব। তাহলে সবাই তাঁদের কথা জানবে। যাঁরা আমাদের বাংলা ভাষার জন্য এতকিছু করেছে, তাঁদের কথা সবার জানা উচিত না? বাবা হাসলেন। তার চোখের কোণে পানি এসে গেল। তিনি তিশিকে আদর করে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মা। অবশ্যই জানা উচিত। তাঁরা যা করেছেন, তার জন্য আমাদের একটু হলেও প্রতিদান দেয়া উচিত। তুমি লেখক হয়ে তাদের কথা লিখে সবাইকে জানাবে। তিশি মাথা নাড়ল। সে ঠিক করে ফেলেছে, লেখক তাকে হতেই হবে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ৯ম শ্রেণী (ইংলিশ ভার্সন)
×