ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সামিউলকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সামিউলকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে পুলিশ রিপোর্টে দেশদ্রোহী চিহ্নিত করা হয়েছিল তাঁকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন বহুদিন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হতে হয়েছিল তার মতো অনেককে। সেইসব স্মৃতি আজও উদ্দীপ্ত করে তাঁকে। তিনি ভাষাসৈনিক একেএম সামিউল হক নান্টু। সে সময় ভাষার দাবিতে যারা রাজপথে ছিলেন সোচ্চার, তাদের প্রায় সবাই মারা গেছেন। যে দু’একজন বেঁচে আছেন আজও, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ স্কাউটের সাবেক পরিচালক সামিউল হক নান্টু একজন। সামিউল হক জানান, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করে। কুড়িগ্রামের ছাত্রসমাজ এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ঢাকা থেকে এ সংক্রান্ত প্রচারপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়। কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্র অ্যাডভোকেট আমান উল্লাহ, আলী আফসার, আবুল ফজল, আফজাল হোসেন, মোস্তফা বিন খন্দকার এই ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেদিন কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের কুড়িগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম জুুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা মিছিলে অংশ নেয়। সামিউল হক নান্টু জানান, ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে ছাত্র ধর্মঘট, মিছিল ও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ভাষাসৈনিক নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র জনতার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই রাতেই স্থানীয়ভাবে গঠিত ভাষা সংগ্রাম পরিষদের গোপন বৈঠক হাবিবুর রহমান খোকার বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোস্তফা বিন খন্দকার সভাপতিত্ব করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ, রেজা হোসেন খন্দকার, হাবিবুর রহমান, আবদুল জলিল, আবদুর নুর, আলী আসাদ, আয়নুল হক, যমেত আলী, এটিএম আফজাল, বাদল রুদ্রসহ অনেকে। সভায় হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। শহরে ঢোল পিটিয়ে প্রচারও করা হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাচ ধারণ করে নগ্ন পদে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিল। কুড়িগ্রাম জুনিয়র হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র সামিউল হক নান্টুও সেদিন ছিলেন মিছিলে। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ছাত্র জনতার মিছিলটি জাহাজ কোম্পানি মোড় পার হয়ে মুসলিম লীগ নেতা পনির উদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে। তাঁকে জুতা খুলতে বললে তিনি প্রচ- রেগে যান। এ সময় ওই নেতা বলেন, আমরা মুসলমান, আমাদের ভাষা হবে উর্দু।’ তিনি পুলিশকে মিছিল ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ মিছিলে হামলা চালিয়ে বাদল রুদ্রকে গ্রেফতার করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ছাত্রদের। পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে কুড়িগ্রাম ১ নম্বর মাঠের স্কুলে মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা আহ্বান করা হলে সেখানেও পুলিশ বাধা দেয়। পরদিন বাদল রুদ্রের মুক্তির দাবিতে আবারও মিছিল হয়। তিন দিন পর তিনি ছাড়া পান। সেই থেকে আন্দোলনকারীদের পেছনে ছায়ার মতো ছিল পুলিশ। তবে তখন পর্যন্ত কোন শহীদ মিনার ছিল না কুড়িগ্রামে। ’৫৩ সালে শহীদ দিবসের আগের দিন এ্যাডভোকেট আমান উল্লাহ, সাংবাদিক তোফায়েল হোসেন, সামিউল হক নান্টু, আবদুল আহাদ, আবদুল হামিদ, হিমাংশু রায়, বুদ্ধু দেব সরখেল, জয়ন্ত রুদ্র, অ্যাডভোকেট আসাদসহ কয়েকজন মিলে কুড়িগ্রাম গওহর পার্ক মাঠে (এখন মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয় মাঠ) শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ব্যবসায়ী আনছার মিয়া ও মকবুল হোসেনের কাছে ইট ও বিভিন্ন জনের কাছে চাঁদা তুলে তড়িঘড়ি করে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়, যাতে ২১ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে আন্দোলন বেগবান করা যায়। কিন্তু রাতের আঁধারে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয়। এতে উদ্যোক্তারা হতাশ না হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পাহারা বসিয়ে শহীদ মিনারটি পুনরায় নির্মাণ করেন। পরদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার শত শত মানুষ শ্রদ্ধা জানান শহীদ মিনারে। সেই শহীদ মিনার নির্মাণের কথা আজও ভুলতে পারেন না সামিউল হক। পাশাপাশি ১৯৫৪ সালে ঈদগাহ মাঠের জনসভায় মাওলানা ভাসানী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। Ñরাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে
×