ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেপালকে হারাল ৬ উইকেটে

ইতিহাস গড়ে যুব বিশ্বকাপের সেমিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ইতিহাস গড়ে যুব বিশ্বকাপের সেমিতে বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ ॥ জিততে ১১ বলে ৩ রান দরকার। লংঅন ও মিড উইকেটের মাঝখান দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন জাকির হাসান। সঙ্গে সঙ্গে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আনন্দ, উৎসব শুরু হয়ে গেল। সেই আনন্দ গোটা দেশকেই আচ্ছন্ন করল। বাংলাদেশ যুব দলের খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফরা দৌড়ে মাঠে আসলেন। ম্যাচ জেতান দুই হাফসেঞ্চুরিয়ান, ১১৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়া জাকির হাসান (৭৫*) ও মেহেদী হাসান মিরাজকে (৫৫*) জড়িয়ে আনন্দ উদযাপন করতে থাকলেন সবাই। নেপাল যুব দলকে ৬ উইকেটে হারও যে নিশ্চিত হয়ে গেল। এ জয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যে উঠে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক কোন টুর্নামেন্টে প্রথম দল হিসেবে শেষচারে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস গড়াও যে হয়ে গেল। তবে এ ইতিহাস গড়ার পথটি সহজ হলো না। গ্রুপ পর্বে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা, স্কটল্যান্ড ও নামিবিয়াকে যত সহজে হারানো গেছে, সুপার লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে নেপালের গড়া ২১১ রান অনায়াসে অতিক্রম করা হলো না। তবে যেভাবে জয় মিলেছে, তাতেই আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। চরম উত্তেজনাকর একটি ম্যাচ হলো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও হলো। শেষপর্যন্ত ১০ বল বাকি থাকতে ২১৫ রান করে ম্যাচে জিতে শেষ হাসি হাসল মিরাজবাহিনীই। গ্রুপ পর্বে যেভাবে প্রতিপক্ষকে বল হাতে চেপে ধরতে পেরেছেন সাইফুদ্দিন, মিরাজ, শাওনরা; কোয়ার্টার ফাইনালে এসে নেপাল ব্যাটসম্যানদের সেভাবে চাপে ফেলতে পারেননি। অধিনায়ক রাজু রিজাল একাই ৭২ রান করে ফেলেন। তার সঙ্গে সুনীল ধামালার ২৫, প্রেম তামাংয়ের অপরাজিত ২২, দিপেন্দ্র সিং আইরির ২২, আরিফ শেখের ২১ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ২১১ রান করল নেপাল। তবুও ইনিংস শেষে মনে হয়েছিল, এবারও সহজ জয়ই মিলবে। যেভাবে দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা, অনায়াসেই ২০০ রান স্কোরবোর্ডে জমা করে ফেলছেন; তাতে নেপালের গড়া এ রান আর তেমন কী! তা করতে গিয়েও কষ্টের মধ্যে পড়তেই হয়েছে। ৯৮ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলার পর যখন বাংলাদেশের আশা ‘পেন্ডুলামে’র মতো দুলছে, এমন সময়ে অধিনায়ক মিরাজ এসে দলের হাল ধরলেন। আগেই উইকেটে থাকা জাকির আর মিরাজ মিলে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ২৯ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ১০০ রান জমা হয়। তখনও জিততে ১২৬ বলে ১১২ রান লাগে। মিরাজ-জাকির মিলে স্কোরবোর্ডে রান ও বল সমান রাখেন। যেন শেষে গিয়ে খুব বেশি চাপ না পড়ে যায়। উইকেট আঁকড়ে থাকেন। ২৫ রানের সময় স্ট্যাম্পিং হওয়া থেকে বাঁচেন মিরাজ। তখনও বাংলাদেশের জিততে ৭৭ বলে ৭৭ রান লাগে। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে যেন মিরাজ সাবধানী হয়ে ওঠেন। সিঙ্গেল, ডাবল করে নিতে থাকেন দুইজনই। টানা সাত ওভারে (৩৬ ওভার থেকে ৪২ ওভার পর্যন্ত) কোন বাউন্ডারিই হয়নি! একটা সময় জয়ের জন্য যখন ৪৮ বলে ৫৭ রানের দরকার থাকে, শুরু হয় বাউন্ডারি হাঁকানো। ৪৩ ওভারের চতুর্থ বলে আইরির বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে যেন আমেজ এনে দেন জাকির। এরপর থেকে আবার বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন দুইজনই। জাকির আগে অর্ধশতক পূরণ করেন। এরপর মিরাজও একই পথের পথিক হন। দুইজন মিলে ১০০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। বাংলাদেশের জিততে যখন ১৮ বলে ১৭ রান লাগে, জয়ের কাছাকাছি চলে যায় দল, ৫৫ রান করা মিরাজ আবারও স্ট্যাম্পিং হওয়া থেকে বাঁচেন। আর আউটই হন না। ১২ বলে যখন ৭ রানের প্রয়োজন, ৪৯তম ওভারের প্রথম বলে চার ও দ্বিতীয় বলে ছক্কা হাঁকিয়ে জয় এনে দেন জাকির। আনন্দ শুরু হয়ে যায়। ইতিহাস গড়াও হয়ে যায় বাংলাদেশের। এখন সেমিফাইনালে খেলার পালা। মঙ্গলবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে প্রথম সেমিফাইনাল খেলবে বাংলাদেশ। সোমবার চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার যে দল জিতবে, তাদের বিপক্ষেই সেমিফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ। জাকির সর্বোচ্চ অপরাজিত ৭৫ রান করেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর যেভাবে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, হাল ধরেন অপরাজিত ৫৫ রান করা মিরাজ; এজন্য তাকেই ম্যাচসেরা ঘোষণা করা হয়। ম্যাচ শেষে মিরাজ জানান, ‘খুব ভাল লাগছে। আমরা প্রথম বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠছি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আমাদের প্রথম পরিকল্পনাই ছিল সেমিফাইনাল খেলব। আমাদের ভেতর বিশ্বাস ছিল। এজন্যই এটা করতে পেরেছি। আমরা কিন্তু চাপেই ভাল খেলি। সেটা হয়েছে সবার ভেতর বিশ্বাসটা আছে বলে। অধিনায়ক হিসেবে আমি সবসময় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চাই। দল যেন সবসময় ভাল ফল করে এবং আমি যেন তাতে অবদান রাখি। আমি কখনই চাপ নেই না। উপভোগ করি সবসময়। দলের সবাই আমাকে খুব সাহায্য করে, সবাই খুব ভাল।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আসলে আমরা কখনই চাপ নেইনি। উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য অনেক ভাল। নেপাল কিন্তু প্রথম দিকে অনেক রান করেছে, আমাদের বোলাররা ভাল বোলিং করে ওদের রান কমে আটকে রেখেছে। উইকেট এখানে ওভারপ্রতি চার-পাঁচ রান করে করার মতো। ২৭০-২৮০ রানের উইকেট। আমাদের বোলাররা ভাল করে ওদের কমে আটকে রেখেছে। শুরুতে আমাদের উইকেট পড়ে যাওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমি আর জাকির সেট হওয়ার পর কিন্তু ভাল ব্যাট করেছি। সমস্যা হয়নি।’ জাকিরের প্রশংসা করতে গিয়ে মিরাজ বলেন, ‘জাকির অবিশ্বাস্য খেলেছে। আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে যে জিনিসটা, জাকির অনেক দিন পর রানে ফিরেই খুব ভাল ইনিংস খেলেছে। দলের জন্য খুব ভাইটাল সময়ে এ রকম একটা ইনিংস খেলল। দলের খুব দরকার ছিল এটা। আমি যখন উইকেটে যাই, অবশ্যই একটু চাপ ছিল। কিন্তু জাকিরই আমাকে বলেছিল যে আমরা শুধু সিঙ্গেল খেলব, স্ট্রাইক রোটেট করব। চার-ছয়ের জন্য যাব না। ওর কথা খুব কাজে লেগেছে।’ জাকির ভরসা দিয়েছেন। সেই ভরসায় এগিয়ে গেছেন মিরাজ। তাতে দারুণ সাফল্যও মিলেছে। ‘যেন-তেন’ সাফল্য নয়, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই উঠে গেছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো এত বড় অর্জন মিলেছে। যে ইতিহাস এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোন খেলায় মিলেনি, সেই ইতিহাসই গড়ে ফেলেছে বাংলাদেশ যুবারা।
×