ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান -মুনতাসীর মামুন

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান  -মুনতাসীর মামুন

(৫ ফেব্রুয়ারির পর) দ্বিতীয়ত এর ফলে সেনাবাহিনীর আয়তন হঠাৎ করেই কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়ে গেল। রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যই যে মেধাবী বহু দক্ষ সেটা যেমন বলা চলে না, তেমনি দক্ষ এবং মেধাবী ব্যক্তিত্ব যে বহু ছিল সেটাও সত্য। আমার নাতিদীর্ঘ চাকরি জীবনে যেসব সাবেক রক্ষীবাহিনীর অফিসার বা সৈনিকের সংস্পর্শে এসেছি, তাদের বেশিরভাগের সম্বন্ধে আমি এখনও উচ্চ ধারণা পোষণ করি।” [পৃ. ৩০-৩১] ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ইবরাহিম লিখেছেন, “বলা বাহুল্য ১৫ আগস্টের ঘটনা পুরো সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিদ্রোহ ছিল না। এটা ছিল অতিক্ষুদ্র সেনাদলের পক্ষ থেকে সংগঠিত কর্মকাণ্ড। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং সকল পর্যায়ের সকল গোয়েন্দা কর্মকর্তার ব্যর্থতা।” [পৃ. ৩৫] এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই, কেন নই, তা আগে লিখেছি, সুতরাং এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না। আরো দুটো বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে সব সেনা কর্মকর্তার লেখায়। তাহলো ১৫ আগস্ট পরবর্তী বিশেষ করে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি, মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান ফেরত সেনাদের দ্বন্দ্ব। ইবরাহিম লিখেছেন, “সেনাবাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সদস্যরা তখন এক হতে পারেনি।” [পৃ. ৩৭] নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে অনেকের বহু মতামত। তবে ইবরাহিমের এই যুক্তি সঠিক যে, ১৫ আগস্ট যা চলছিল তাতে এ ধরনের ঘটনা অবশ্যম্ভাবী ছিল। “ঘটনা ৭ নভেম্বরে না ঘটলেও কোনো না কোনো বিশৃঙ্খলা অন্য যে কোনো সময় ঘটা প্রায় আবশ্যম্ভাবী ছিল। ৭ নভেম্বর থেকে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব বা লায়াবিলিটিজ তৎকালীন জাসদের। অপরপক্ষে যাবতীয় প্রাপ্তি তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার।” [পৃ. ৪২] দুটি বাক্যে এত চমৎকারভাবে ৩-৭ নভেম্বরের ঘটনার ব্যাখ্যা কোনো সামরিক কর্মকর্তা করতে পারেননি। তবে তার লেখা বাক্যটি তার আগের মন্তব্য যে সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র দল ১৫ আগস্টের জন্য দায়ী তার বিপরীত। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আজ তৎকালীন জাসদকে যতই বিপ্লবী হিসেবে তুলে ধরা হোক না কেন অন্তিম বিশ্লেষণে জাসদ সেনাবাহিনীর মতোই বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। ৭ নভেম্বরের ঘটনা এখনও সবাইকে হন্ট করে এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি ফেরত সবাই উৎসাহী হলেও এক সময় না এক সময় দুপক্ষের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম তফাত থেকেই যায়। যেমন, মেজর হাফিজ প্রসঙ্গ। ইবরাহিম লিখেছেন, মেজর হাফিজ ছিলেন ফার্স্ট বেঙ্গলে যারা জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে। পরে ৭ নভেম্বর “সন্ধ্যার আগে মেজর হাফিজ বীরবিক্রমের নেতৃত্বে এবং সৈনিকদের আগ্রহে গোটা ব্যাটালিয়ন সেনানিবাসে ফেরত আসে। ব্যক্তিগত আকুল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান তাকে ক্ষমা করে দেন।” [পৃ. ৪২] ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ ঘটনা আবার ফিরে আসে। দুটি পত্রিকার রিপোর্ট উদ্ধৃত করছিÑ ১. “বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার ও হত্যা করা নিয়ে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ. স. ম. হান্নান শাহ ও অস্থায়ী মহাসচিব মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদের মধ্যে বাহাস অব্যাহত আছে। লে. জেনারেল (অব) মীর শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। তার বক্তব্য অসত্য হতে পারে না বলে জানালেন হান্নান শাহ। তিনি বলেন, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামনে মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে যাওয়া হলে জিয়ার পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চান তিনি। জিয়াউর রহমান তাকে ক্ষমা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী থেকেও অবসর দিয়ে দেন। অন্যদিকে দলের স্থায়ী কমিটির মনোনীত অস্থায়ী মহাসচিব মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, লে. জেনারেল (অব) মীর শওকত আলীর বক্তব্য ভুল। পদাতিক ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন হাফিজ নামে এক কর্মকর্তা জিয়াকে আটক করতে গিয়েছিলেন। জিয়াকে আটক করতে আমি যাইনি। হয়তো ক্যাপ্টেন হাফিজের কর্মকাণ্ড এখন মেজর হাফিজের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। জিয়াকে আটক করতে গিয়েছি তা প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন বলেও জানান মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। তবে এই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে যে দুজনের নাম মীর শওকত আলী বলেছেন মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ একইভাবে ওই দুজনকেই সাক্ষী মানছেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ. স. ম. হান্নান শাহ ও মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ পৃথকভাবে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর হাফিজ কী করেছেন সে সম্পর্কে লে. কর্নেল (অব) এমএ হামিদের লেখা তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ের কিছু অংশ পড়ে শোনান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) হান্নান শাহ। তিনি বলেন, ৩ নভেম্বরের ঘটনায় কারা জড়িত ছিলেন? এই বইয়ে মেজর হাফিজের নাম অনেকবার লেখা আছে। হান্নান শাহ বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব) রফিকের বইয়েও মেজর হাফিজের নাম উল্লেখ আছে। আর যে ক্যাপ্টেন হাফিজের কথা বলা হচ্ছে সেই হাফিজ চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শহীদ হয়েছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নেমকহারাম ছিলেন না। এদিকে ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে আটকের ঘটনা অস্বীকার করে স্থায়ী কমিটির মনোনীত অস্থায়ী মহাসচিব মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জিয়াউর রহমান মাত্র তিন দিন বন্দি ছিলেন। আমি বন্দি ছিলাম না। আর তার আটকের ব্যাপারে আমি জড়িতও ছিলাম না। সেনাবাহিনীতে মাত্র ৬ বছর ছিলাম। এরপর নিজেই অবসর নেয়ার জন্য আবেদন করি। পরে আমাকে অবসর দেয়া হয়। তিনি বলেন, মীর শওকত আলী আমার সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ অসত্য ও মিথ্যা। জিয়াকে আটক করার ঘটনায় খালেদ মোশাররফ জড়িত ছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রধানকে গ্রেপ্তার করতে সেনাসদস্যরা ইচ্ছে করে যান না। সিনিয়রদের নির্দেশ থাকে। ওপরের বড় কর্মকর্তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মেজর জেনারেল (অব) ইবরাহিম ৯০-এর দশকে সেনাপ্রধানের লিখিত নির্দেশ পেয়ে একটি কাজ করতে গিয়ে তার চাকরি হারিয়েছেন। মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনীতি নিয়ে এখন ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি করা হচ্ছে। তবে কিছু পত্রিকা ও চ্যানেলের সাংবাদিকরা এসব বিভ্রান্তি ঘটাচ্ছেন। অপসাংবাদিকতা করছেন তারা। এমন সাংবাদিকতা করা উচিত যাতে দেশের মানুষের কাজে লাগে। তিনি বলেন, কেউ আমাকে যদি মহাসচিব মেনে না নেন তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিএনপিতে আমি ১৬ বছর ধরে আছি। আর মীর শওকত আলী মাত্র ৬ বছর বিএনপি করছেন। আমি ’৯১ সালে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হই। ’৯২ সালে বিএনপিতে যোগ দেই। আর মীর শওকত আলী বিএনপিতে এসে মন্ত্রী হয়েছেন।” [সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ, ৫.১১.২০০৭] ২. “মেজর (অব) ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীক রোববার এক বিবৃতিতে বলেছেনে, ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনীর কোর্স চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের মহড়ায় ইন্সট্রাক্টর হান্নান শাহ তাদের বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে তোমরা আমার বাঁ পা করেছ, ভুলে যাও তোমাদের বাকওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ।’ চলবে...
×