ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থিয়েটার কর্মীদের ঝাড়ু ধরাচ্ছেন মোদী

প্রকাশিত: ১৯:১২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

থিয়েটার কর্মীদের ঝাড়ু ধরাচ্ছেন মোদী

অনলাইন ডেস্ক ॥ শতাধিক বছর আগে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ তাঁর ‘আলিবাবা’ নাটকে গান লিখেছিলেন, ‘মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর..!’ এ বার গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীদের দিয়ে সেই কাজটাই করিয়ে নিতে চায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার! কেন্দ্রীয় অনুদান পেতে গেলে এ বার নাট্য সংস্থাগুলিকে সামিল হতেই হবে প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানে। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি আই এ কমল সম্প্রতি চিঠি দিয়ে বাংলার ৬৮টি গ্রুপ থিয়েটারকে এই শর্তের কথা জানিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তির ১৪ নম্বরে থাকা ওই শর্তে বলা হয়েছে, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ভাবনা রূপায়ণ ও প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে অনুদান প্রাপকদের। ২০১৯ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্কুল, হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে এই কর্মসূচি পালন করতে হবে। তার ছবি ও সংশ্লিষ্ট শংসাপত্র (কেন্দ্রকে) জমা দিতে হবে।’ চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শর্ত পূরণ করলে তবেই মিলবে অনুদান। অনুদান পেতে নানা শর্ত মানতেই হয়, মানছেন বাংলার নাট্যকর্মীরা। কিন্তু স্কুল, হাসপাতাল বা বাসস্ট্যান্ড পরিষ্কারের ছবি তুলে পাঠানোর উপরেও সেই অনুদান পাওয়া-না পাওয়া নির্ভর করছে জেনে বাংলার নাট্যব্যক্তিত্বদের একটা বড় অংশই অসন্তুষ্ট! রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যকার-নির্দেশক ব্রাত্য বসু বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার থিয়েটারে অনুদান বন্ধ করে দিতে চাইছে। সাদা বাংলায় কেন্দ্র বলছে, ‘অনুদান দেব, যদি মোদীর নামে জয়ধ্বনি দাও। না হলে অনুদান বন্ধ।’ এ তো তালিবানি ফরমান!’’ অভিনেতা-নির্দেশক কৌশিক সেনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কেন্দ্রের এই শর্ত অসম্মানজনক। আপত্তিকরও বটে! চলচ্চিত্রের মতো নাটকে টাকা-পয়সা আসে না, সরকার এটা জানে। আর জানে বলেই এমন শর্ত আরোপ করেছে।’’ কৌশিকের অভিযোগ, বিজেপি সরকার আসার পর থেকেই অনুদানের টাকা দেওয়া নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু হয়েছে। ব্রাত্য বিষয়টিকে ‘তালিবানি ফরমান’ বলায় আপত্তি তুলেছেন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর দফতরই ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের দায়িত্বে রয়েছে। বাবুল বলেন, ‘‘নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়, তৃণমূলের মন্ত্রী বলেই ওই মন্তব্য করেছেন ব্রাত্যদা!’’ গায়ক-মন্ত্রীর যুক্তি, ‘স্বচ্ছ ভারত’ কর্মসূচি রূপায়ণ জরুরি। ব্রাত্য বা কৌশিকের মতো সাংস্কৃতিক কর্মীরা যদি একটি হাসপাতালের কোনও অংশ পরিষ্কার করেন, তা হলে কেন্দ্রীয় ওই প্রকল্প নিয়ে জনমানসে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। একে ‘তালিবানি ফরমান’ হিসেবে দেখা ঠিক নয়। অভিনেতা-নির্দেশক মেঘনাদ ভট্টাচার্য অবশ্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের শর্ত মেনে তাঁর দল ‘সায়ক’-এর সদস্যদের নিয়ে উল্টোডাঙায় বালিকাদের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাফাইয়ের কাজ সেরেছেন। শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে শৌচালয়ও সাফ করেছেন নাট্যকর্মীরা। মেঘনাদবাবুর কথায়, ‘‘এটা আমি ইতিবাচক ইঙ্গিত বলেই ধরছি। অনুদানের টাকা পেতে তো এটা করতেই হবে!’’ তবে মেঘনাদবাবু জানিয়েছেন, তাঁরা কী নাটক করবেন-না করবেন— তা নিয়েও যদি এর পরে কোনও শর্ত আসে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা অনুদানের জন্য আর আবেদন করবেন কি না ভেবে দেখবেন। অভিনেতা-নির্দেশক চন্দন সেন সোজাসাপ্টা জানিয়েছেন, সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রচার অভিযানে তিনি সামিল হবেন না! কেন্দ্রের নির্দেশের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে শীঘ্রই বিভিন্ন নাট্যদলের কাছে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ব্রাত্য। তাঁর কথায়, ‘‘এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে আমাদের থিয়েটারের শিল্পীদের একত্র হতে হবে। যে কোনও তালিবানি দল চাইবে নাটক, শিল্পচর্চা ধ্বংস হোক! প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে একমাত্র থিয়েটার।’’ যদিও কৌশিক মনে করেন, সংগঠিত প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। কারণ, অনুদান-নির্ভরতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এখানে একক ভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য প্রতিবাদ করছেন ঠিকই। তবে বিশিষ্টদের একাংশ মনে করেন, এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নানা পুরস্কার ও ভাতা দিয়েই শিল্পীদের সরকারি প্রচারের কাজে ব্যবহার করে থাকে। চন্দন যেমন বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাউলদের টাকা দিচ্ছে সরকারি প্রচারের জন্য। দিল্লিও এমন নির্দেশিকা দিয়ে থাকলে সেটা একই মানসিকতার পরিচয়!’’ আর কৌশিকের মতে, ‘‘তৃণমূল যা করছে, তা নতুন নয়। সিপিএমের সরকারও করেছে। হয়তো তাদের মাত্রাটা কম ছিল। কিন্তু এতে থিয়েটার বন্ধ হয়নি। হবেও না!’’ সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×