ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

সুফিবাদ শিল্প-সাহিত্য সাধারণত যুগের কালীন প্রবণতার সাথে সংহতি বজায় রেখে এগিয়ে চলে। কিন্তু সুফিবাদই ব্যতিক্রম এক মরমী শিল্প-দর্শন যা মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে আজ অবধি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শিল্প-সাহিত্যে উপস্থিত। আর শুধু সেটাই আধুনিক শিল্প-সাহিত্য প্রবণতার সাথে সুফিবাদকে মিলিয়ে ফেলার কারণ। পারস্যের কবিদের মাধ্যমে সুফিবাদ প্রসার লাভ করে, তাঁদের মধ্যেÑশামস তাবরেজী, জালালুদ্দিন রুমি, হাফেজ সিরাজী, শেখ সাদী, আবদুর রহমান জামী, ফরিদ উদদীন আত্তার অন্যতম। প্রেমের সম্প্রদায় ব্যতীত এঁদের আর কোন সম্প্রদায় নেই। এঁদের পথ, মত ও মন্তব্য অন্য সাধারণ ধার্মিকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা যার ফলে শুরুর দিকে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর পরিণতির অন্যতম উদাহরণ মনসুর হাল্লাজ। তবে মনসুর হাল্লাজের শাহাদাত বরণের পর থেকে সুফিগণ তাদের রচনাবলী এতদূর নেপথ্যে নিয়ে যান, যার বোঝাবুঝি সাধারণ এমনকি শারীয়তপন্থীরাও বক্তব্যের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। রুমিই বলছেন, ‘তোমরা কি শোননি, দেখা ও শোনার কত তফাৎ?’ গাজ্জালী থেকে আমরা পাই এক সর্বব্যাপী সার্বিক সত্তার বিজ্ঞান ও মতবাদ আর রুমি থেকে পাই অনুভূতি, বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে। ‘প্রত্যেক জিনিস তাঁর মধ্যে এবং তিনি সবকিছুর মধ্যে।’ রুমির খোদা কোন সার্বিক সত্য নয় বরং ব্যক্তিত্ব বিবর্জিত একটি অতি জাগতিক নীতি। ব্যক্তিত্ব হিসেবে এ সত্তা এতই ব্যাপক যে তা সব অস্তিত্ব সর্বকার্যকলাপ ও সকল বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তা সার্বিকভাবে অন্তর্বর্তী ও পরমভাবে অতিবর্তী এবং তা নিজকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে। আসলে মানুষ স্বর্গীয় সত্তার প্রতিরূপ হওয়ার জন্য নিজের আসল প্রকৃতি অর্জন করা ছাড়া কিছুই না! আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে সুফিবাদ ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে বিশেষত মার্কিন সাহিত্যিক এবং পাঠকদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় সুফিদের রহস্যময় জগত, চিন্তা ও কথামালার উৎস অন্বেষণ। নাইজেল ওয়াটস, কোলম্যান বার্কস, ডরিস লেসিংসহ অনেক মার্কিন সাহিত্যিক আজ এই অন্বেষণে নিয়োজিত। প্রেম, সৌন্দর্য এবং মানবতার এ এক অনিন্দ্য সম্মিলনÑ ‘তুমি নয়নের একঠারে আমাকে বিধ্বস্ত ও বরবাদ করে দিলে/আর আমার পরিধানে হাজার হাজার কণ্টক ঢেলে দিলে/প্রেমের শর সব জায়গাতে নিপতিত হলে/শরবিদ্ধ প্রেমিককে কোনো তদবীর করে মুক্ত করা যায় না।’ ইউসুফ জোলায়খা : মোল্লা জামী। স্বভাববাদ প্রকৃতিবাদী অথবা স্বাভাববাদী সাহিত্যিকরা বাস্তববাদীদের চাইতেও অধিকতর নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে প্রকৃত জীবনসত্যকে পরিবেশন করতে প্রয়াস পান। যা কিছু স্বাভাবিক ও সম্ভব সেটা যেমনই হোক না কেন স্বভাববাদে তাই মহার্ঘ্য। কিছু সুস্পষ্ট তত্ত্বকে ভিত্তি করে স্বভাববাদী কথা-সাহিত্য গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরুষানুক্রম, পরিবেশ, জৈব তাড়না, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ এবং অপ্রতিরোধ্য নিয়তি যা ঘটনাচক্রের দৈব সংগঠনের বিষয়। এখানে শুধু মহান আদর্শবাদ বা রঙিনসুখী কল্পনাবিলাসের কোনো অবকাশ নেই, এর ঝোঁক হলো বাস্তব জীবনের সেই অংশের প্রতি যা রক্তাক্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, ক্লেদময়, নিষ্ঠুর ও নিচ। আর্ট নোভে ইউরোপের একটি বিশিষ্ট ধরনের নব শিল্প-প্রক্রিয়া উনিশ শতকের শুরুতে স্থাপত্যশিল্পের আবঙ্কিম রেখাগত অলঙ্করণের পদ্ধতিতে চিত্রশিল্পে একটি নতুন শিল্প-প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়। এ শিল্প-পদ্ধতি রোমান্টিক রসাশ্রিত ছিলো। বেলজিয়ান স্থপতি অঁরি ফন দ্য ভেল্দ আবঙ্কিম রৈখিক অলঙ্করণের জন্মদাতা। সাঁকো ‘নীল অশ্বারোহী’ দলের মতোই জার্মানির ড্রেসডেনে ১৯০৫ সালে একটি সংঘবদ্ধ শিল্প-অনুশীলনের নাম ‘সাঁকো’। এ উভয় দলই প্রতিবাদের শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এঁরা উভয়েই অভিব্যক্তিবাদের দুটি দলগত রূপ। রং-এর অকুণ্ঠ প্রয়োগের মধ্যেই এর বিশিষ্টতা। লিপিশিল্প যে সমস্ত ভাষার বর্ণলিপি সরল সমমাপের নয় কিন্তু লম্ব স্বভাবের, সমান্তরাল, বৃত্তাকার এবং আবর্তিত বিচিত্র ভঙ্গির সে সমস্ত বর্ণলিপিই বিস্ময়কর লিপিশিল্প বা ক্যালিগ্রাফির জন্ম দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আরবী বর্ণমালা এবং চৈনিক বর্ণমালার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সমস্ত লিপির সাহায্যে নানা ফর্ম গঠন করা সম্ভবপর। আধুনিকালে এসব লিপিভঙ্গির সাহায্যে ইউরোপের অনেক শিল্পী বিমূর্ত চিত্র নির্মাণ করেছেন। এক অর্থে লিপিশিল্পের প্রকাশভঙ্গিকে বিস্তারিত এবং সমন্বিত করেই বিমূর্ত প্রকাশময়তা নির্মিত হয়েছে বলা যায়। স্যাটায়ার যে রচনা আলোচ্য বিষয়কে লঘু ও তুচ্ছ করে তার প্রতি অবজ্ঞা, ঘৃণা, ক্রোধ বা কৌতুকের মনোভাব জাগিয়ে তোলে তাকে ‘স্যাটায়ার’ আখ্যা দেয়া যেতে পারে। ‘কমিক’ রচনা থেকে এর পার্থক্য এখানে যে, কমিক-রচনা নিছক হাস্যরসই প্রধান। তার পেছনে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু স্যাটায়ার হাস্যরসকে ব্যবহার করে অস্ত্রের মতো, তার উদ্দেশ্য পরিহাসাত্মক ছুরি চালিয়ে কোনো অন্যায়, অবিচার বা অসঙ্গতিকে আক্রমণ করা। এই আক্রমণের পাত্র কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তি হতে পারেন, এক বিশেষ ধরনের মানুষ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান, কিংবা জাতি হতে পারে, এমনকি সমগ্র মানবজাতিও হতে পারে। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায় রচেস্টারের ‘অ ঝধঃুৎ ধমধরহংঃ গধহশরহফ’ এবং জোনাথন সুইফট-এর গালিভার্স ট্র্যাভেলস-এর কথা। ইংরেজি সাহিত্যে ব্যঙ্গ-রচয়িতাদের মধ্যে রয়েছেন- ড্রাইডেন, সুইফট, বাটলার, আলেকজান্ডার পোপ প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গ রচনায়- প্রমথ চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ ও সৈয়দ মুজতবা আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেন্টিমেন্টালিজম বর্তমানে ভাবালুতা কথাটির অভিঘাত নেতিবাচক। প্রকৃতার্থে আবেগের কিংবা ভাবের চূড়ান্ত স্পন্দন ব্যতীত উন্নত শিল্প সৃষ্টি হতে পারে না। শিল্প-সাহিত্যে ভাবের ভূমিকাই মুখ্য। সহানুভূতি উদ্রেকের উদ্দেশ্যে লেখক যখন করুণ রসের আধিক্য সৃষ্টি করেন তখন তা সেন্টিমেন্টালিজম বলে গণ্য করা হয়। ইংরেজি রোমান্টিক কবিদের মাধ্যমেই মূলত সাহিত্যে ভাবালুতার প্রবেশ ঘটে। সেই সময়কাল থেকে আজ অবধি পৃথিবীর নানা ভাষার সাহিত্যে ভাবালুতার প্রভাব স্পষ্ট এবং অনেক ক্ষেত্রে অপরোক্ষ। (চলবে)
×