ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

ভাঙা সাঁকোর গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভাঙা সাঁকোর গল্প

ভাঙা সাঁকোর কাছ ঘেঁষে বাসটা থামলো, শেষ স্টপেজ। লক্কড়-ঝক্কড় বাসটার প্রাণ যেন বা বাঁচলো, হাঁপাতে হাঁপাতে কালো ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে জেরবার ওর অবস্থা। প্রকৃতির মাঝে এসে নিজেকে ভারি স্বাভাবিক মনে হলো, ড্রাইভার আর কন্ডাকটর বাসের মধ্যে বসেই টিপের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। দু’দশজন যাত্রী শেষ স্টপেজে নেমে উৎফুল মনে বাড়ি ফিরে যায়। নাগরিক সভ্যতা তাদের দোরগোড়ায় এসে পড়েছে, কম কিসের। বুক টান টান করে একটু দেমাকি মেজাজে কেউ কেউ শেষবেলার বাজার মতো উন্মুক্ত জায়গায় ছুটে যায় আনাজপাতি কেনার জন্য। জায়গাটা শহর থেকে একটু দূর হলেও শহরের তাবৎ বিলাসিতা পৌঁছে গেছে এর মধ্যে, বিজলিবাতি-ডিশ, তার-পল্লীবিদ্যুৎ-গ্রামীণ ব্যাংক প্রভৃতি ছাড়াও আশেপাশে ছোটখাট দোকানগুলো বেশ পসরা নিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে কয়েক বছর থেকে, স্টেশনারিজ-কনফেকশনারি-মুদি-সাইকেল সারায়ের-হোন্ডা সারায়ের দোকানগুলোও আছে, ওদিকে একটা ফার্নিচারের দোকান, পেছন দিকে বরাবরই ছিলো কাঠের আড়ৎ এবং কাঠ ফাড়ায়ের মিল, তেল-মবিলের দোকানও একটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, আর চায়ের স্টলগুলোতে আজকাল হালকা খাবারও পাওয়া যায়। তারপরও গ্রাম্য ভাবখানা বেশ আছে, সারাদিনে দু’ চারখানা লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি এসে হাঁপায় আবার ফাঁকা নিয়ে যায়। পথে মানুষ পেলে তো পোয়াবারো, মানুষজনও তো যন্ত্রচালিত গাড়ি পেলে কে আর রিক্সাভ্যান-নছিমন আর ঘোড়ালাগোয়া টমটমে সোয়ারী হয়। দিনরাত্রির এই খেলা প্রতিদিন দেখে বাদল। মাটির ঢেলার মতো বসে থেকে শহুরে মেজাজি এই গ্রাম্য খেলা দেখতে তার ভালোই লাগে। বাপ চলে যাওয়ার পর থেকেই ভাঙা সাঁকোর পাশের তেল-মবিলের দোকানটাই তার বসার স্থান হয়, রব্বানি চাচা মানুষটা ভালো বলেই কাজটা তাকে দেয়। তেমন কাজ নেই, লোকাল গাড়ি-নছিমন- মোটরসাইকেল সামনে এসে দাঁড়ালে চাহিদামতো তেল-মবিল ঢেলে দেওয়া, তারপর পয়সা বুঝে নেওয়া, রব্বানি চাচা মাথা উঁচু করে হেসে ওঠে, তারপর বাদলের কোনো কাজ নেই আর। শুধু টুলে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষ দেখা। কাজটা পেয়ে বাদল বেশ খুশি। এমন আক্রার বাজারে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কতো আই.এ, বি.এ পাস ছেলে-ছোঁকরা আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা কাজের ধান্ধায়। কে কাকে দেখে আর, সময় বড় যে খারাপ। সেদিন ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব বাদলকে দেখে বলেছিলো, তোর মতো একটা ছেলে আমার দরকার। কাজ তেমন নয়, বাড়িতে বাজার করে দেওয়া আর বেগমের ফুটফরমায়েশ শোনা। বাদল ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনে বেশ গর্বে বুক ফুলিয়ে বলে ওঠে, আশেপাশে ভালো কাজের ছেলে পাওয়া বড় কঠিন, তবু আপনি বলছেন যখন আমি দেখবো। রব্বানি হেসে ওঠে অনেক পরে। বেশ কথা তো শিখেছিস। আমি তো ভেবেছিলাম তুই মনে হয় ম্যানেজারের কথা শুনে পটে যাবি, বাড়ির কাজ মানে তো ভালো ভালো খাওয়াপরা। Ñতা কি করে হয় চাচা, আপনি আমাকে কতো আদর করে রেখেছেন আর আমি বেইমানি করবো আপনার সাথে। একটা হোঁচট খায় মুহূর্তে রব্বানি। বেশ কৃতজ্ঞতাবোধ আছে তো। মালিককে সম্মান দিতে জানে। ওর বাপটাও ছিলো ভালো মানুষ। সুতোশীষের আটামিলে কাজ করতো, হঠাৎ একদিন বনিবনা না হওয়ায় কাজটা ছেড়ে দিলো। তারপর কিছুদিন মদনহাটের মজিবুরের তেলকলে কাজ করেছিলো, রব্বানির সঙ্গে খানিক একটু বেশি রকম সম্পর্ক ছিলো। দুজনে একসঙ্গে কতোদিন যতিনের চোলায়ের আস্তানায় গেছে, চোলাই-ধেনো-তাড়ি খেয়েছে একসাথে। সে কতোকাল আগের কাহিনী। আজো রব্বানির চোখে ভাসে সবই। মাঝে অবশ্যই খানিক ভালো মানুষও হয়ে যায়। নামাজ-বন্দেগী করতে শুরু“ করলো। তখন অবশ্যই রব্বানি পুরোদস্তুর মাতাল মানুষ। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। একদিন অকস্মাৎ সংবাদ পেলো, মদনহাটের কাঠের সাঁকোটা পার হতে গিয়ে ওপাশ থেকে আসা নছিমনের ধাক্কায় উল্টে পড়ে মানুষটা একেবারে নয়ানজুলিতে। আঘাতটা নেহাৎই ছোটখাটো ছিলো না। শরীর থেঁতলে যায়, মাথাতেও মোক্ষম চোট লাগে। সে ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পড়ে খলিল। মাস চারেক ছিলো বটে অনেক কষ্টে বেঁচে। শেষদিকে নিজেকেই চিনতে পারতো না। কঠিন ব্যামো বলে চিকিৎসা করতো না মুস্তাকিন ডাক্তার। এমনকি নদের চাঁদের বাপ ফকির চাঁদ কবরেজও হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। রোগটা যে কি কেউ জানতে না পারলেও কুকুরডাঙার কথিত কামেল পীর শাহ্ মুহাঃ মোবাচ্ছির আলী তর্কবাগীশই বলেছিলো, হাওয়ার ভর। হাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে সে এখন জীবনটাকে উপভোগ করছে। অর্থাৎ হাওয়ার গাড়িতে সওয়ারি সে...পীরের কথা কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু একদিন খবর হয়, খলিল মরে গেছে। সময়টা শীতকাল ছিলো অবশ্যই। রব্বানি আজো ভেবে আফশোস করে। সামর্থ্য এবং ইচ্ছে থাকা সত্তেও সে অর্থসাহায্য করতে পারেনি বন্ধুটিকে। সে কষ্টে আজো জর্জরিত। কিন্তু কি আর করতে পারে বা সে, আর করারই বা কি আছে। বাদলের ছায়া পড়েছে তার দোকানে। ছেলেটা বেশ পয়মন্ত্ ওর মা আর দু’বোন নিয়ে বাদলের সংসার। বাপটা মরে যাওয়ার পর ওর মাকে ছহিদুল হাওলাদারের চালের মোকামে কাজ নিতে হ॥ চাল ঝাড়াই-বাছাই আর কি। কাঁটাবিলের ওদিকটা বাদলরা থাকে। রব্বানির বাড়ির কাছাকাছি। যেতে-আসতে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। বাদলের মা একদিন বলেছিলো, ছেলেটার তো আর লেখাপড়া হবে না। পারলে আপনার কাছে রাখেন না ভাই। রব্বানি কথাটা ফেলতে পারেনি। একটা মানুষের প্রয়োজন ছিলো বরাবরই। হাতের কাছে পেয়ে লুফে নিতে দোষ কোথায়। বাদল মানুষ চেনে বেশ। ব্যাংক ম্যানেজারকে চেনে, রব্বানিকে চেনে, ওর চোখে কতো চেনা-জানা মানুষ ভিড় করে। সব্বাইকে তো এক পালায় রাখতেও চায় না। মকবুল ড্রাইভার কয়েকদিন আগে ডেকেছিলো,গা-হাত-পা মালিশ করে দিতে বলেছিলো। আরেকদিন ওই হারামজাদা হাবলু হেলপার কি একটা জিনিস দেখাতে আঁখক্ষেতের ওপাশে বাঁশঝাড়টা আছে। ওখানে নিয়ে যায়, তারপর বাদলকে বলে প্যান্ট খুলতে, তখনি বাদল খেঁকিয়ে ওঠে। হাবলু ছাড়তে চায়নি, চেপে ধরেছিলো। কিন্তু সম্ভব হয়নি শুধুই ধস্তাধস্তি ছাড়া। চোঁচা দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলো এবং মস্ত একটা মাটির ঢেলা ছুঁড়ে মারে হাবলুর নাক বরাবর। সেদিন থেকে ওই আর কোনোদিন বাদলের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়নি। বাস সড়কের পাশে ভাঙা সাঁকোটার কাছের দোকানে বসে বাদল সারাদিন নানান প্রকৃতির মানুষ দেখে। কতো চেনা-অচেনা মানুষের মুখ দেখতে দেখতে নিজেই একসময় হাঁপিয়ে ওঠে। বাপের কথা মনে হয়। বাপটা ওভাবে চলে গেলো। ভাবতে পারেনি কখনো। মানুষ এভাবে কেনো চলে যায় বোঝে না বাদল। এমন যাওয়া আসার কারণও সে খুঁজতে চায় না। কিন্তু বাপটা তার চলে গেলো। যে যায় সে তো চিরকালের জন্যই যায়, আর ফিরে আসে না। অনেক রাত্রি এখন। বাইরে অমাবস্যায় পৃথিবীজুড়ে অন্ধকার বিরাজ করছে। বাদল শুয়ে আছে মায়ের পাশে। ওপাশে বোন দুটো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মায়ের জন্য কষ্ট হয়। বাপটা মরে যেতেই মাকে কাজ নিতে হলো। কতো পরিশ্রম করে দিনরাত্রি। বাদলের কিছুই ভালো লাগে না। অনেকদূর থেকে আবছা আবছা গান-মাইকের চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে আসছে। উড়ালখলশির বিলে মেলা বসেছেÑ সার্কাস-পুতুলনাচ-যাদুখেলা হয়, অনেক রাত্রে যাত্রাও শুরু“ হয়। রাজ্যের মানুষজন সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ছোটদের খেলনাপাতি থেকে মেয়েদের নানান সাজগোজের জিনিসপত্র দেদার বিকাচ্ছে। গলাকাটা দামেও মানুষ কিনছে। মেলার জিনিসের কদর বেড়ে গেছে। মকবুল ড্রাইভার সেদিন বলছিলো, বাদল রে যাবি নাকি। একদিন চল্। তবে যাত্রাগানও শুনিয়ে নিয়ে আসি। আরে শুধু কি গান নাকি রে, আসলে তো...মানুষটাকে বাদলের তেমন সুবিধার মনে হয় না। কেমন যেন শরীর ঘেঁষা মানুষ। চোখ দুটো জবাফুলের মতো টকটকে। কি খায় কে জানে। বাদল বড় ধন্দে পড়ে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে মকবুল ড্রাইভার বলেছিলো, শোন্ বাদল, নতুন নতুন সুন্দরী মেয়ে মানুষ দেখবি, সব কচি ডাব...ডাসা-ডাসা সাইজ... শুনতে ভালো লাগেনি বাদলের। মানুষ কতো খারাপ হতে পারে- কি মুখের ভাষা, শরীর জ্বলে যায়। তারপরও কিছু বলতে পারেনি ওকে। কারণ রব্বানি কাকা বলেছে, ওরা আমাদের কাস্টমার, ওদের সম্মান করতে হবে। বাদল কিছু বলতে পারেনি। শুধু মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলো, রাত্রে মা আমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাবে। কারণ, মা ছাড়া যেমন ওর কোনো ভালো আপনজন নেই তেমনি বাদল ছাড়াও মায়ের কেউই নেই। আসলে বাপটা মরে যাওয়ার পর মা আরো নিসঙ্গ হয়ে গেছে। কেমন যেন ঝিমধরা একটা পাখি। বাদলের মনে অনেক কষ্ট, অনেক না বলা কথারা পাগলের মতো ঘুরেফিরে কিছু যেন বলতে চায়। কোনো কিছুই সে বোঝাতে পারে না কাউকে। মায়ের পাশে শুয়ে আছে বাদল। কতো কথা মনে হচ্ছে এখন। রাত্রি হলে মানুষ অনেক কিছু ভাবতে পারে। ভাবনাগুলো হুড়মুড় করে ছুটে আসে মাথার ভেতর। ঘুম আসছে না এতোটুকু। আজ কেনো ঘুম আসে না চোখে। ঘুম কি সব পালিয়ে গেলো রাজকন্যার দেশে। অনেকদিন মা রাজারাণী-রাজকন্যার রাক্ষস-খোক্ষস, ভূত-পেতিœর গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়নি। বাপটা মরে যাওয়ার পর সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। মাকেও আর সেভাবে পাওয়া যায় না। অথবা কাছে পাওয়া গেলেও সেভাবে আর গল্প শোনা হয় না। মায়ের কাছে কতো গল্প জমা আছে, সবই তো বাদল আর বোনদের জন্য। আচমকা দরোজাটা নড়ে উঠলো। কে যেন বাইরে থেকে ঠেলে দিচ্ছে। বাদল কি বলার আগেই ওর মা ধড়ফড় করে উঠে দরোজা খুলে বাইরে চলে যায়। সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে বাদল বুঝতে পারেনি কিছুই। আস্তে আস্তে সে উঠে দরোজার দিকে যায়। তারপর কতোগুলো ছিদ্র দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে কিছু দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মিশমিশে কালো অন্ধকার। পৃথিবীতে এতো আঁধার যেন বাদল আগে দেখেনি। কিন্তু তার মা কোথায় গেলো? দরোজা খুলতে গিয়ে বুঝতে পারে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছে। বাদল কিছুই বুঝতে পারে না। কেমন সব লণ্ড ভণ্ড কাণ্ড ঘটছে, চেনা মুখ অচেনা হয়ে যায়। অন্ধকার বড় বেশি হতাশা ছড়ায়। তারপরও চেষ্টা করে আরেকটা বড় ছিদ্র দিয়ে বাইরে দেখার। একটা রশ্মী জাতীয় আলো নাকি জোনাকির আলো অথবা সিগারেটের আগুন, বুঝতে পারে না সে। কিন্তু একটা মানুষ- রব্বানি কাকা- হাবলু-মকবুল ড্রাইভার-নাজিম হাওলাদার-ব্যাংক ম্যানেজার...কারো মুখ বাদল স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারে না। সমস্ত চেনা মুখ কেমন আবছা হয়ে যায়। অচেনাকে খুঁজতে পারে না। চেনা রাত্রিও ক্রমে ক্রমে অচেনা বধূর মতো মুখ লুকোয় মেঘের শামিয়ানায়।
×