ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সব ব্যয় বহন করবে সরকার ॥ স্বাস্থ্যমন্ত্রী

‘বৃক্ষ মানব’ আবুলের চিকিৎসা শুরু হবে রিপোর্ট পাওয়ার পর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

‘বৃক্ষ মানব’ আবুলের চিকিৎসা শুরু হবে রিপোর্ট পাওয়ার পর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন বৃক্ষ মানব আবুল বাজনদারের সুনির্দিষ্ট রোগ ও চিকিৎসা পদ্ধতি শনাক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা। প্লাস্টিক সার্জন, মেডিসিন এবং চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আবুল বাজনদার ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগেই আক্রান্ত বলে ধারণা করছেন ঢামেক মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিছু রক্ত ও টিস্যু বায়োপসি পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব রিপোর্ট হাতে পেলে মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী চূড়ান্ত পর্যায়ের চিকিৎসা শুরু করা হবে। আবুল বাজনদারের রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার সব খরচ সরকার বহন করবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বৃহস্পতিবার ঢামেক বার্ন ইউনিটের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক মোঃ আবুল কালাম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমান প্রমুখ। মূল প্রতিবেদন তুলে ধরে অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। সংবাদ সম্মেলনের আগে রোগী ও তাঁর স্বজনদের দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। আবুল বাজনদারকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে চিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করবে। তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি পাঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। এ মানুষটিকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রতিনিয়তই মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এ রোগের বিষয়ে দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন। দর্শনার্থীরা যাতে আবুল বাজনদারকে বিরক্ত না করেন সেজন্য তাঁকে আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আপনারাও তার কক্ষে বেশি না গেলে চিকিৎসার জন্য সুবিধা হবে বলে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন বলেন, এক বিরল রোগে আক্রান্ত আবুল বাজনদার (২৫)। খুলনার পাইকগাছার সড়ল গ্রামে তাঁর বাড়ি। আট ভাই-বোনের পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান আবুল বাজনদার বছরপাঁচেক আগে বিয়ে করেছেন। এখন তিনি তিন বছরের এক কন্যা সন্তানের বাবা। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। ভ্যান চালিয়ে সংসারের ভরণপোষণ করে আসছিলেন আবুল বাজনদার। মাত্র দশ বছর বয়সে ত্বকে ভাইরাসের সংক্রমণে বর্তমানে হাত-পায়ে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো আঁচিল নিয়ে হাসপাতালে দিন কাটছে তাঁর। খুলনার বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ৫১৪নং কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন। গত ১০ বছর ধরে তিনি বিরল এ রোগে আক্রান্ত। দশ বছর আগে তিনি তাঁর দু’ হাঁটুর নিচের দিকে ছোট ছোট কয়েকটি কালো রঙের আঁচিল দেখতে পান। এগুলো ধীরে ধীরে দু’ পা ও হাতে ছড়িয়ে পড়ে। হাতের আঁচিলগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে গাছের শুকনো বাকলের মতো হয়ে যায়। গত ৫ বছর ধরে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন না। এমনকি নিজে খেতেও পারেন না। পাঁচ বছর ধরে তিনি মাঝে মাঝে তাঁর দু’ হাতে ও পায়ে এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভব করেন। তিনি প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসা নেন এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করেন। পরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ভারতের চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে এই রোগকে ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ বলে শনাক্ত করেন। অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন আরও জানান, প্রাথমিকভাবে রোগীর ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আবুল বাজনদার খুব সম্ভবত ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগেই আক্রান্ত। এ রোগ ‘ট্রি-ম্যান সিনড্রোম’ হিসেবে পরিচিত। তবে নিশ্চিতভাবে বলার আগে আমাদের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা প্লাস্টিক সার্জন, মেডিসিন এবং চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৬ সদস্যের মেডিক্যাল টিম গঠন করেছি। মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ/নির্দেশনা অনুয়ায়ী চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নরিস কম্প্রেহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারের চিকিৎসক মার্টিন কাস্ট আমাদের সঙ্গে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন। তিনি গত ২০ বছর ধরে এই ‘ট্রি-ম্যান সিনড্রোম’ এর রোগীর গবেষণা কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি ইন্দোনেশিয়ার রোগী ডেডির চিকিৎসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি আমাদের কিছু রক্ত ও টিস্যু বায়োপসি পরীক্ষার জন্য পাঠাতে বলেন। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাঁরা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেছেন। অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগ নির্ণয় শেষ করে মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করব। এই রোগীর চিকিৎসা এবং তাঁর থাকা, খাওয়ার সকল ব্যয়ভার বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে আমাদের হাসপাতাল বহন করবে বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মোঃ আবুল কালাম বলেন, প্যাথলজিক্যাল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়া হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোর প্রতিবেদন পেতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর যদি আমাদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় তাহলে অস্ত্রোপচারে যাব। তবে অস্ত্রোপচার করা হবে কয়েকটি ভাগে। রোগের উৎস সম্পর্কে জানা না থাকলেও ‘জেনেটিক ও ভাইরাস’জনিত কারণ এর পেছনে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবুল কালাম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, এইচপিভি একগুচ্ছ ভাইরাসের নাম, যা শরীরের ত্বক ও আর্দ্র ঝিলিতে সংক্রমিত হয়। এ পর্যন্ত এক শ’র বেশি ধরনের এইচপিভি ভাইরাসের হদিস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০ ধরনের এইচপিভি জননেন্দ্রীয়কে আক্রান্ত করতে পারে। সব ধরনের এইচপিভিই শরীরে আঁচিলের কারণ। এ সংক্রমণ খুব দ্রুত গতিতে ত্বকের বাইরের স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। মা-স্ত্রীর হাতেই খাবার খেতে হয় আবুল বাজনদারকে। এক-একটি হাতের আঙ্গুলের ওজন কয়েক কেজি। উঁচু করতে পারেন না; অনেক কষ্ট হয়। তবে দুই পায়ের অবস্থা হাতের মতো নয়। ঘুমের বড়ি ছাড়া ঘুমাতে পারেন না।
×