ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুঁজি ও মার্কেটিংয়ের অভাবে উৎপাদন বন্ধ;###;সরকারী উদ্যোগের পণ্যটি কিনছে না তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও;###;শুরুতে ত্রুটি থাকায় নেতিবাচক ভাবমূর্তি আর কাটিয়ে ওঠা যায়নি

স্বপ্ন জাগানো দেশী ল্যাপটপ ॥ কেমন আছে দোয়েল!

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

স্বপ্ন জাগানো দেশী ল্যাপটপ ॥ কেমন আছে দোয়েল!

ফিরোজ মান্না ॥ অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এসেছিল। মানুষের মধ্যে আগ্রহও ছিল প্রচুর। ডিজিটাল বাংলাদেশে দেশীয় ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ এর আগমন সাড়া জাগিয়েছিল গোটা দেশে। তথ্য প্রযুক্তির এই পণ্যটিতে আমদানিনির্ভর থাকতে হবে না। স্বল্পমূল্যে পাওয়া যাবে দেশীয় পণ্য। এমন স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল দেশের মানুষকে। এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তির দেশী উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি। খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি মানুষের স্বপ্ন। দোয়েলের নাম এখন প্রায় ভুলেই গেছে সবাই। শুরুতেই ক্রটিপূর্ণ কিছু ল্যাপটপ তৈরির কারণে গ্রাহকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি, মূলধনের অভাব, প্রচার এবং বিপণনে দুর্বলতায় এই দেশী পণ্যটি মুখথুবড়ে পড়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। কেমন আছে দোয়েল? আদৌ আছে নাকি নিঃশব্দেই শেষ হয়ে গেছে সরকারী এই উদ্যোগ? অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখনও টিম টিম করে জ্বলছে এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। কর্মকর্তাদের ভাষায়, ‘মূলধনের অভাবে প্রায় বন্ধের পথে দোয়েল ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ-নোটবুকের উৎপাদন ও বিপণন। টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) তৈরি সাশ্রয়ী মূল্যের দোয়েল ল্যাপটপ এখনও আছে। সরকারী দফতর থেকে চহিদাপত্র পাওয়া গেলে খুব সীমিত আকারে সরবরাহ করা যায়। তাও মাত্র দু’টি ব্র্যান্ডের। বাকি দু’টি ব্র্যান্ড উৎপাদন একেবারেই বন্ধ।’ নিকট অতীতে কোন দফতর থেকে চাহিদা পাওয়া গেছে কিনা এমন তথ্য জানাতে পারেননি কোন কর্মকর্তা। টেশিষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিটিসিএল-এর কাছ থেকে ৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দোয়েল উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালের জুলাইয়ে। কয়েক মাস যেতে না যেতেই বিটিসিএল ঋণের টাকা ফেরত নিয়ে যায়। তখন বেশ কিছু দিন উৎপাদন একেবারেই বন্ধ ছিল। পরে আবার উৎপাদন শুরু করলেও প্রচারের অভাবে দোয়েল বিক্রি করা যাচ্ছে না। সরকারী প্রতিষ্ঠানই ছিল দোয়েলের মূল খরিদ্দার। পরে সরকারী প্রতিষ্ঠানও এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটির এমন অবস্থা, যে কোন সময় একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খোলা বাজারে বিক্রির জন্য কার্যত এখন আর কোন ল্যাপটপ তৈরি হয় না। তিনটি বিক্রয় কেন্দ্র ল্যাপটপশূন্য। টেশিসের সামনের বিক্রয় কেন্দ্রে দু’একটি ল্যাপটপ আছে। ফার্মগেট ও গুলিস্তানের বিক্রয় কেন্দ্রে কোন ল্যাপটপ নেই। ২০১৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০ হাজার ৫শ’ ল্যাপটপ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১০ হাজার ল্যাপটপ নেয়ার জন্য টেশিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। সেই সময় টেশিস ৩০ হাজার ৫শ’ ল্যাপটপ উৎপাদন করতে পারেনি। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনী টেশিসের কাছ থেকে ল্যাপটপ নিতে পারেনি। বাজারে যে সব নামী দামী কোম্পানির ল্যাপটপ পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে দোয়েল কোন অংশে কম নয়। ডেল, এক্সপি ব্র্যান্ডের সমমানের দোয়েল ল্যাপটপ কোর আই-৩ ও কোর আই-৫। বুয়েটের সহযোগিতায় এই ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ চাহিদা সাপেক্ষে উৎপাদন করা হচ্ছে। শুরুতে তৈরি করা হয়েছিল এ্যাডভান্স ১৬-১২ আই-৩ মডেলের ল্যাপটপ। এই মানের ল্যাপটপ বাজারে ৪৫ হাজার টাকার ওপরে দাম রয়েছে। দোয়েল বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৩শ’ টাকায়। পরের ব্র্যান্ড হচ্ছে এ্যাডভান্স-১৬-১২ দাম ২৮ হাজার ৫শ’ টাকা, স্ট্যান্ড মডেলের দাম ২০ হাজার ৫শ’, বেসিক মডেলের দাম ১৫ হাজার ৫শ এবং প্রাইমারি মডেলের দাম ১০ হাজার ৫শ’ টাকা। উৎপাদনের শুরুতে দু’টি ব্র্যান্ড কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ রাখা হয়েছিল। এখন দু’টি ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ উৎপাদন বা এ্যাসেম্বল করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি ল্যাপটপের জন্য মাইক্রোসফট কোম্পানি বিনামূল্যে সফটওয়্যার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। যে সফওয়্যারের দাম দুই থেকে আড়াই শ’ মার্কিন ডলার। এখন এই সফওয়্যার নাম মাত্র মূল্যে কিনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এন্টিভাইরাসসহ কোর আই-৩ বা ১৬-১২ আই ল্যাপটপ তৈরি করা হচ্ছে। টেশিসের জিএম কবির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, একদিকে পুঁজিহীনতা-অন্যদিকে মার্কেটিংয়ের অভাবে দোয়েল উৎপাদন বন্ধই রয়েছে। তবে কোন সংস্থা যদি চাহিদাপত্র দেয় সেক্ষেত্রে কয়েকদিন সময় নিয়ে আমরা তা উৎপাদন করে দিচ্ছি। চীনের হেয়ার কোম্পানি থেকে ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ এনে আমরা টেশিসে তা এ্যাসেম্বল করে সরবরাহ করি। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি সরকারী দফতরে যোগাযোগ করেছি দোয়েল নেয়ার জন্য। কোন সংস্থাই সাড়া দিচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বাইরে থেকে ল্যাপটপ নোটবুক কিনছে। আমাদের কাছ থেকে দোয়েল নিচ্ছে না। একই ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। এই দু’টি মন্ত্রণালয়ই ছিল আমাদের বিক্রি করার মূল জায়গা। ডেল ও এক্সপির মতো মান সম্পন্ন ল্যাপটপ আমরা উৎপাদন করলেও দোয়েল কোন সংস্থাই নিচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটি একদিন একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দাম এত কম থাকায় গ্রাহকদের মধ্যে প্রচুর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল দেশী এই পণ্যের প্রতি। ধীরে ধীরে এই আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণ গ্রাহক শুধু নয়, সরকারী প্রতিষ্ঠানও ল্যাপটপ কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পণ্যের নিম্ন মানকে দায়ী করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, কমমূল্য হলেও নিম্ন মানের এই ল্যাপটপ কিনে সমস্যায় পরতে চাই না। কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে গেলে এর দায় কে নেবে। এমন অভিযোগ সম্পর্কে টেশিস কর্মকর্তারা বলেন, শুরুতে দু‘টি মডেলে ক্রটি ছিল। পরে এগুলো সংশোধন করা হয়। শুরুতে পণ্যটির যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল তা আর কাটিয়ে ওঠা যায়নি। তারা দাবি করেন, সম্পূর্ণ নতুন একটি উদ্যোগে এমন সমস্যা হতেই পারে। পরবর্তী সময় তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছে। জানা গেছে, দুই বছরে মাত্র ৩০ হাজারের মতো দোয়েল ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে। এর বেশির ভাগই কিনেছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। এ ছাড়া তিনটি বিক্রয় কেন্দ্রে খুচরা বিক্রি কার্যক্রম থাকলেও সেখানেও গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না। যথাযথ প্রচার ও বিপণনের অভাবে এ সম্পর্কে ল্যাপটপ ব্যবহারকারীরা তেমন কিছু জানেন না। প্রচার ও বিপণন কার্যক্রম আমরা যথাযথভাবে করছি না মূলত মূলধনজনিত জটিলতায়। বাজারে দোয়েলের চাহিদা রয়েছে। কারণ এই ল্যাপটপ নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব। প্রচার করার পর চাহিদা বাড়বে-তখন যদি সরবরাহ দেয়া সম্ভব না হয়। সেই কারণে প্রচারের কাজটিও থেমে আছে। চাহিদা দেখা দিলে তার বিপরীতে ল্যাপটপ সরবরাহ করার মতো মূলধন টেশিসের নেই। টেশিস জানিয়েছে, ল্যাপটপ উৎপাদনে প্রাথমিকভাবে ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের টাকা বাংলাদেশ সরকার ও মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান থিম ফিল্ম ট্রান্সমিশনের (টিএফটি) তরফ থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু কোন তরফ থেকেই টাকার যোগান হয়নি। বিটিসিএল থেকে ৪৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার কোম্পানি এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর টেশিস চীনের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রাংশ কিনে উৎপাদন শুরু করে। এখন প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। টাকার যোগান না হলে সরকারের এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে যে কোন সময়। টেশিস বলছে, আপাতত রিভলবিং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসাবে ৫০ কোটি টাকা প্রযোজন। কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই টাকা ঋণ নেয়ার চিন্তা ভাবনা করছে কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের জুনে সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ল্যাপটপ উৎপাদনের ঘোষণা দেয়। এ জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিফোন শিল্প সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রাধমিকভাবে ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান থিম ফিল্ম ট্রান্সমিশন ও বিদেশী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সাহায্যে কাজ শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১০ জুলাই গাজীপুরের টেশিস কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে এর উৎপাদন শুরু হয়। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর দেশীয় ব্র্যান্ড ‘দোয়েলের’ বিতরণ ও বাজারজাত কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।
×