ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রসূল

প্রশ্নগুলো পুরনো; উত্তরগুলোও

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

প্রশ্নগুলো পুরনো; উত্তরগুলোও

রাজনীতি শব্দটির অর্থ যত ব্যাপকই হোক না কেন, একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শব্দটির কিছু মৌলিক চরিত্র নির্মিত হয়। এর ধারাবাহিকতাতেই রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। নানা মতবাদ সত্ত্বেও একটি প্রশ্নে তাত্ত্বিকভাবে হলেও নানা আদর্শের সকল রাজনৈতিক দলই স্বীকার করে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত জনগণের জন্যই। ইংরেজীতে ওফবড়ষড়মু কথাটিকে অস্তিত্বের মূর্ত অবস্থানের সঙ্গে বিমূর্ত সম্পর্ক হিসেবে দেখানো হলেও রাষ্ট্রভেদে এই সংজ্ঞায়ন এত সরল নয়। আর নয় বলেই অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের নিজস্ব আদর্শ গড়ে উঠে আর তা স্বীকার করেই রাজনৈতিক মতবাদগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। কারণ, রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আদর্শ। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও এর আদর্শিক বীজ রোপিত হয়েছে সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার, বর্বর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একষট্টির রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন, চেতনার মশাল জ্বালিয়ে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা, উত্তাল অগ্নিঝরা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, আত্মমর্যাদার সত্তরের নির্বাচন আর অধিকার বুঝে নেয়ার একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ- একটি দীর্ঘ, ব্যাপ্ত, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতির জনকের নেতৃত্বে বাঙালীর সূর্যমুখী বিজয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই আমাদের আদর্শিক লড়াই, আমাদের অস্তিত্বের প্রগাঢ় অর্জন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন ভূ-খণ্ড হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বের মানচিত্রে তার আদর্শের ইশতেহার রচিত হয়েছে আরও আগেই। সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, কূপমন্ডূক পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়নের অপ-আদর্শকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, সাম্য ও গণতান্ত্রিক দর্শনের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাই কেবল আমাদেরই নয়, পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা। এটি কেবল এই জন্য নয় যে, একটি বর্বর রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘমালার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অপারেশন; বরং পাকিস্তানের মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন আবর্জনা-দর্শনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের প্রবাদপ্রতিম সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মননশীল উদ্বোধন। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে একটি পারাবারপ্রতিম আদর্শকে সামনে রেখে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা সূচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতেই, যদিও এ ধারাবাহিকতা পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও পাকিস্তানী অপদর্শনের প্রেতাত্মারা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, বন্ধ হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে একাত্তরের পাকিস্তানী দোসররা। এ হচ্ছে পঁচাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতার চিত্র; কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রের যে মৌলিক আদর্শÑ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শÑ তা অবিচল থাকে। আর থাকে বলেই পঁচাত্তরের একুশ বছর পর হলেও আবারও ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলÑ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই একুশ বছরে অবশ্য বাহাত্তরের সংবিধান ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, রাষ্ট্রের নানা কাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। সবচেয়ে বড় কথা, এই একুশ বছরে যে প্রজন্ম বেড়ে ওঠেছে তাদের মানস কাঠামোতে সচেতনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানী অপদর্শনের বিষ। প্রতিষ্ঠিত হয় এমন কিছু রাজনৈতিক দল, যাদের মতবাদ আদতে বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনা ও পাকিস্তানী ভাবাদর্শকেই নিজেদের রাজনৈতিক গঠনতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশের আদর্শচ্যুত এই রাজনৈতিক দলগুলো সব সময়ই পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসে এরা নানাভাবে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। একাত্তর পরবর্তী সময় থেকেই পাকিস্তানের যে বাংলাদেশবিরোধী অপরাজনীতি তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। ॥ দুই ॥ মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে উদ্ভট ও বিকৃত মন্তব্যের কারণে এক আইনজীবীর করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আমলে নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সম্প্রতি সমন জারি করেছে আদালত। আগামী ৩ মার্চের মধ্যে আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন ঢাকার মহানগর হাকিম। দলটির স্থায়ী কমিটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও শহীদের সংখ্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত বক্তব্য দিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের সমন জারি বস্তুত গণদাবিরই প্রতিফলন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে শক্ত আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে সর্বত্র। লক্ষণীয়, আদালতের সমন জারির পর গয়েশ্বর চন্দ্র আবারও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে বক্তব্য প্রদান করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির এ ধরনের মিথ্যাচারের পেছনে কী কেবলই তাদের গণ্ডমূর্খতা কাজ করছে, নাকি পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকেই চলে আসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নবতর সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছেÑ সেটি আলোচনার দাবি রাখে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রতিষ্ঠা, উত্তরণের ইতিহাস ও কার্যাবলী দেখলেই বোঝা যায়, এরা সব সময়ই বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বর্বর আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। এদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও গৃহীত হয়েছে জঙ্গীরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশনে। ষাটের দশকে বাংলার মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য বর্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করছে রাজপথে, সে সময় (১৯৫৯-১৯৬৪) জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিল। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা হিসেবেই সে চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করে। এই রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈনিকদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালী; কিন্তু কমান্ডার ছিল অবাঙালী। স্বভাবতই সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের ওপর তারা আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মোহভঙ্গ হয় যখন জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না গড়ে উল্টো সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে তৎপর হয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের কী ভূমিকা তা নির্ধারণের আগে বিচার করতে হবে, সে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগে দীর্ঘ সময় কর্মরত ছিল, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে দুটি খেতাব অর্জন করেছিল এবং ১৯৭০ সালের পর বাঙালী যখন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে তখন তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই চট্টগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রেরণ করা হয়েছিল। আর এ কথা সকলেই অবগত যে, বাঙালী হত্যার জন্য পাকিস্তানের আনা অস্ত্রগুলো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই খালাস হয়। আবার পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার মাত্র দশদিন পর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যাবার আগ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীতে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। জিয়ার হাত দিয়েই পুরস্কৃত করা হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের। জেনারেল থাকাকালীন সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে জিয়াই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক প্রণীত দালাল আইন বাতিল করে (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭৫)। ঝবপড়হফ ঢ়ৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ৎফবৎ হড়. ২ ড়ভ ১৯৭৬ জারি করে তুলে দেয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি। জিয়ার সরকারের নির্দেশেই (১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৬) বাতিল হওয়া নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য আবেদন করে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম। জিয়ার গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কফিনে ঠুকে দেয়া একেকটি পেরেক। আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূ-লুণ্ঠিত করে জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় বিএনপি (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮)। বিএনপির প্রতিষ্ঠা এবং তার বর্তমান কার্যকলাপে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানের খেদমত জারি রাখার প্রশ্নে জিয়াউর রহমান দূরদর্শী ছিল। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি জিয়াউর রহমানের ছদ্ম-মুক্তিযোদ্ধা তকমাটি সামনে রেখে স্বাধীনতাবিরোধী অপতৎপরতা অব্যাহত রাখে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তারা নতুন প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে, অন্যদিকে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবার জন্য একটি রাজনৈতিক সাব-স্টেশন হিসেবেই বিএনপি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কারণ, সে সময় পাকিস্তানের দোসর জামায়াতসহ অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ এবং তাদের নেতাদের অনেকেই ছিল পলাতক। তাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার জন্যও বিএনপি পাকিস্তানের পক্ষে বিশ্বস্তপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার জামায়াতে ইসলামী ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ নানা জঙ্গী প্রতিষ্ঠানের অনুদানে অর্থনৈতিকভাবে হƒষ্টপুষ্ট হতে শুরু করে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির স্টিয়ারিংটি থাকে বিএনপির হাতে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের অর্থনৈতিক ফুয়েল হিসেবে কাজ করতে থাকে জামায়াতে ইসলাম। যারা বিএনপি-জামায়াতের জোট নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বা আশা করেন, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলেই বিএনপির পুণ্যস্নান সমাপ্ত হবে তাদের এটি জানা প্রয়োজন যে, জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়াটাই ছিল বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য। কারণ এটাই পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন। যে জামায়াতের নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনে ন্যক্কারজনকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বহুবার, তারাই বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে বসেছে, মন্ত্রী হয়েছে। সুতরাং আদর্শগতভাবে বিএনপি আর জামায়াত যে ভিন্ন কিছু নয় এটা সকলের কাছেই পরিষ্কার। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের আদর্শ বাস্তবায়নকারী আর বিএনপির রিমোর্ট কন্ট্রোল আইএসআই সদর দপ্তরে রাখা আছে। ॥ তিন ॥ বর্তমান মহাজোট সরকারকে নানা সঙ্কট মোকাবেলা করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বাংলার মানুষের যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তার প্রতি সরকার শ্রদ্ধাশীল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই বর্তমান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট এখনও অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে একের পর এক বক্তব্য দেয়া, পেট্রোলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যা, মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়েই যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন এখন বাংলার মানুষের কাছে আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে একটি পক্ষেরও উদ্ভব ঘটেছে, যারা ‘তথাকথিত নিরপেক্ষতা’র একটি রং মেখে আছেন। বাংলাদেশের অস্তিত্বের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাসের প্রশ্নে অনুসন্ধিৎসু গবেষণা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে; কিন্তু নির্জলা সত্যকে উদ্ভট যুক্তি দাবি করে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে তাদের প্রত্যেকেরই অসৎ উদ্দেশ্য আছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোন নিরপেক্ষতা থাকতে পারে না; কারণ মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের সকল কিছুর ভূমিকা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি সবকিছুই নির্ধারিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোতে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রেক্ষিতে। বর্তমানে বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক অর্থহীন আস্ফালন আর জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নজির দেখলেই বোঝা যায়, এরা পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের মতোই এদের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে মাত্র। কিন্তু মানুষ যেহেতু এদের প্রত্যাখ্যান করছে, তাই মাঠে নেমে গেছে তাদের পেয়ারা পাকিস্তানও। যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের পরই পাকিস্তান নামক ব্যর্থ রাষ্ট্রটি নানা ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ ও বক্তব্য দিতে থাকে। গণহত্যার দায় অস্বীকার করে এই ঘৃণ্য বর্বররা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসে এখনও জঙ্গী অর্থায়ন চালাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরটি খোঁজার মধ্য দিয়েই লেখা শেষ করব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের কী অবস্থান তা জাতির কাছে স্পষ্ট। পাকিস্তান যে এই বিএনপি-জামায়াত জোটের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ধ্বংসের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে বিষয়ে কারোরই কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে এই শ্বাপদ জোটের বিরুদ্ধেও শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অতি সত্বর। পাকিস্তানের হাইকমিশনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে নানা ধরনের বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার বাংলাদেশের প্রশ্নে পাকিস্তান যে ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য দিচ্ছে তার বিরুদ্ধেও সরকারের কোন শক্ত অবস্থান লক্ষণীয় নয়। সরকার যদি মনে করে বিষয়টি সময় নিয়ে পর্যালোচনা করবে তাহলে তাদের এটাও মনে রাখা উচিত যে, পাকিস্তান প্রসঙ্গে সময় নষ্ট করার মতো সময় বাংলাদেশের নেই। ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘনের অনেকগুলো নজির ইতোমধ্যেই পাকিস্তান স্থাপন করেছে। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এই সাহসী পদক্ষেপকে আরও শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকারের পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে নতুনভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ে ভাবা উচিত। সরকারের আরেকটি বিষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রতিটি মানুষের মাঝে হতাশার জš§ দিয়েছে। বারবারই মনে হচ্ছে পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে যেন সরকার পা দিচ্ছে। বাংলাদেশের নানা স্থানে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কীভাবে দেখছে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশিকিছু, তাই মানুষের আস্থার সোপানটি নড়ে যাচ্ছে মাঝে-মধ্যেই। এই অনুপ্রবেশকারীরা মুখে যতই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলুক, এদের জিনোমে আসলে পাকিস্তানের প্রোটিন। এই অনুপ্রবেশকারীরা মূলত দলের ত্যাগী, বিচক্ষণ নেতাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। আর আওয়ামী লীগের কিছু উচ্চাভিলাষী নেতা এসব ভোল পাল্টানো জামায়াত-বিএনপিকে দলে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে মূলত সফল হচ্ছে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। এমনিতেই পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা পর্যায়ে পাকিস্তানপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা তৈরি করে আরও কিছু বিষদাঁত। এরাই লেবাস বদলে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের নীলনক্সা আঁকছে। ক্ষমতায় থেকেই এদের মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, যতটা শক্ত হওয়া প্রয়োজন ততটা শক্ত তারা হচ্ছে না। তারপর যদি আবার নিজের দলের মাঝেই এভাবে বিএনপি-জামায়াতদের আওয়ামী লীগ বানিয়ে ঢুকানো হয়, তাহলে সর্বনাশের আর অন্ত থাকবে না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক এই কৌশলটি কী আওয়ামী লীগের একেবারেই চোখে পড়ছে না? কারোরই না? জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি বহুদিনের। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ছয় দফা দাবিতে সুস্পষ্টভাবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের মাঝে কোন দোটানা মনোভাব বিরাজমান তা স্পষ্ট নয়। অনেকেই বলে থাকেন, নিষিদ্ধ করলে জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ড দলে পরিণত হবে তখন তাদের অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আরও কঠিন হবে। এই সমস্যাটির কথা মাথায় রেখেই গণজাগরণ মঞ্চ ছয় দফা দাবিতে উল্লেখ করেছিল যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কারণ, এদের অর্থের উৎস বন্ধ করে দিলেই এদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইটি এগিয়ে নেয়া যাবে। সময় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজনীতিতে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালক্ষেপণ ঠিক ততটাই মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল। পাকিস্তানী পুঁজে জন্ম বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা ফুল হাতে দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তাদের মারাত্মক রাজনৈতিক ভুলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না এ সংশয় আজ জনগণের মধ্যে তীব্র। সংশয়ের এ তীব্রতাকে যদি আওয়ামী লীগ আমলে না নেয় তাহলে আবারও ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরতে শুরু করবে। কারণ ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একবার জন্মালেও খন্দকার মোশতাকরা কিন্তু বারবারই জন্মায়। লেখক : গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী [email protected]
×