ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘চিন্তা রক্তবীজের মতো একটাকে নিহত করলে দশটা উঠে আসবে’

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

‘চিন্তা রক্তবীজের মতো একটাকে নিহত করলে দশটা উঠে আসবে’

মোরসালিন মিজান ॥ শুরুটা রোদেলা ছিল। মিষ্টি রোদ যখন পশ্চিম আকাশে, প্রবেশ পথগুলো খুলে দেয়া হয়। তারও আগে থেকে অপেক্ষা করে ছিলেন বইপ্রেমীরা। ঘড়িতে তিনটা বাজতেই ঢোকার অনুমতি মেলে। কেউ বাংলা একাডেমি চত্বরের দিকে এগিয়ে যান। কেউ সোহরাওয়ার্দীর মূল আয়োজনে। ঘোরাঘুরি। বই দেখা। পাতা উল্টানো। এই করে এক ঘণ্টার মতো সময়। ততক্ষণে মুখ ভার আকাশের। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। নামতে পারে। শঙ্কা ছড়িয়ে পরে মেলায়। প্রস্তুতি নিতে থাকেন প্রকাশকরা। আশার কথা, বৃষ্টি আর হয়নি। বরং সন্ধ্যায় বেশ জমে ওঠে মেলা। বাংলা একাডেমি অংশে গায়ে গা লাগা ভিড় ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মাঝখান দিয়ে ইট বিছিয়ে অস্থায়ী পথ তৈরি করা হয়েছে। প্রশস্ত সেই পথের পাশে যেসব স্টল, সেগুলোর সামনে ছোটখাটো ভিড় ছিল পুরোটা সময়। বই খোঁজা ও বই কেনা চলছে। তবে, আর সব স্টল থেকে কেমন যেন আলাদা হয়ে গেছে আক্রান্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর মেলায় যে ‘জাগৃতি’ বা ‘শুদ্ধস্বর’ দেখা গেছে, এবার তেমনটি নেই। বাংলা একাডেমির বিপরীত দিক দিয়ে প্রশস্ত প্রবেশ পথ। নতুন এই পথ ধরে সামান্য এগিয়ে গেলে জাগৃতি প্রকাশনী। বড়সড় স্টলই বটে। দুই পাশে রাস্তা। সহজেই চোখে পরে। আর তখনই দেখা যায়, শোকের কালো রংটা। গোটা স্টল সাদা কালো রঙে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবছর যেভাবে বই সাজানো থাকে এবারও সাজানো। শুধু স্টলের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক সজ্জন ফয়সাল আরেফিন দীপন নেই। সৃজনশীল এই প্রকাশককে, তরুণ স্বপ্নবাজকে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে। নিজের অফিস কক্ষে ঢুকে মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করে। সারা দেশ তোলপাড় হওয়া এই ঘটনার পর আবারও মেলায় অংশগ্রহণ। দীপনের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন স্ত্রী। বিকেলে সেখানেই ছিলেন তিনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। না, চেহারায় বেদনার তেমন ছাপ নেই। সব বোধকরি বুকে জমিয়ে রেখেছেন। সকলকে চাঙ্গা রাখতে শক্তি যোগাতেই হয়ত এমন রূপ। কথা বলতে গিয়েও খুব স্বাভাবিক মনে হলো কণ্ঠটিকে। বললেন, আমি প্রথমবার স্টলে থেকে কাজ করছি না। প্রতিবছরই মেলায় এসেছি। স্টলে থেকেছি। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত নতুন ছয়টি বই তারা মেলায় এনেছেন। আসবে আরও ২০টির মতো। পুরনো নতুন বইয়ের মাঝে এদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি অভিজিৎ রায়ের কোন বই। গত বছর বইমেলা থেকে ফেরার পথে মৌলবাদী আক্রমণে খুন হন এই মুক্তমনা লেখক। তাঁর বই প্রকাশ করায় খুন করা হয় দীপনকে। এর পর আর বলার অপেক্ষা রাখে না, কেন বইটি নেই। ভয়ে আতঙ্কেই হয়ত রাখা হয়নি বইটি। কথার এক পর্যায়ে স্টলে আসেন দীপনের পিতা আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি নিজে লেখক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বুদ্ধিজীবী। তাই তাঁর কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল, মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিয়ে। আজকের বাস্তবতায় কতটা আছে মুক্ত বুদ্ধির চর্চা? উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন মুক্তবুদ্ধির চর্চা নেই। মুক্তবুদ্ধির একটা ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। বললেন, মুক্তবুদ্ধি বলতে যা বোঝায় সেটা হচ্ছে, সমাজের কল্যাণ হবে। জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সমাজের সংঘাত সংঘর্ষ মারামারি কাটাকাটি কমবে। এবং প্রগতির দিকে যাবে। সেই অর্থে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাংলাদেশে নেই। এই পিতা এমনকি সন্তান হত্যার দায় কেবল মৌলবাদী চক্রকে দিতে রাজি নন বলে মনে হলো। তাঁর বক্তব্যটি একমÑ যারা হত্যা করেছে তারা জঘন্য রকমের অপরাধী। মানুষের অবস্থানে থেকে কেউ এ ধরনের হত্যাকা- করতে পারে না। যারা মানবতার পর্যায় ছেড়ে চলে গেছে তাদের কাছে শুভবুদ্ধি আশা করার কিছু নেই। তারা করুণার পাত্র। শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে শুধু জল্লাদদের দোষ দিয়ে কী হবে? সকল মহলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যারা প্রগতিশীল দাবি করেন তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া বেশি দরকার। কিন্তু যারা প্রগতিশীল তারাই তো এমন রাজনীতি দেশে তৈরি করেছেন, যে রাজনীতি আমার ছেলের প্রাণ নিল। তাঁর মতে, সকলের চিন্তার মধ্যে মৌলিক ভুল আছে। এভাবে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে আলাপচারিতা। উপসংহারটি যেন দীপন টানেন। স্টলের ভেতরে বড় একটি প্রতিকৃতি তাঁর। সেই চিরচেনা মুখ। ছবির নিচে জীবনানন্দের কতিার পঙক্তিÑ অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে/ পৃথিবীতে আজ...। আক্রান্ত আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরে গিয়ে দেখা যায়, সেই শ্রী নেই। প্রতিবছরই স্টলটি খুব নান্দনিকভাবে সাজানো হতো। বই দেখানো ও বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকতেন কর্মীরা। এবার সেই চেনা মুখগুলো নেই। একেবারেই অপরিচিত অনভ্যস্ত কয়েকজন স্টল খুলে বসেছেন। নিহত অভিজিৎ রায়ের একাধিক বই এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এই কারণে আক্রান্ত হন প্রকাশক টুটুল। মৃত্যু থেকে কোন রকমে ফেরা টুটুল এখন বিদেশে। সেখান থেকেই তিনি জানিয়েছিলেন, এবারের মেলায় তাঁর সব ধরনের প্রকাশনা রাখা হবে। কিন্তু সব বই খুঁজে পাওয়া গেল না স্টলে। অভিজিৎ রায়ের একটি পুরনো বই সাজানো ছিল। সবুজ নামের একজন জানালেন, এবার নতুন কোন বই আসবে না মেলায়। পুরনো অনেক বইও রাখা হচ্ছে না স্টলে। তাঁরা স্টল চালানোর চাকরি করছেন জানিয়ে সবুজ বলেন, আমরা কোন কিছুই ভাল জানি না। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রোদেলাও গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এবার সেটি খোলা হয়েছে। এখানেও প্রকাশনা সীমিত। যাচাই বাছাই করে বই আনা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে কেমন যে একটা পরাধীন অবস্থা। লেখকরা কীভাবে দেখছেন? জানতে কথা হয় সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। বুধবার মেলায় এসেছিলেন তিনি। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কোন হত্যাকা-ই সমর্থনযোগ্য নয়। লেখক হত্যা তো নয়ই। প্রকাশক হত্যা তো নয়ই। যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের জন্য নিশ্চয়ই দুঃখ করব। শোক করব। এই ঘটনার অবসান চাইব আমরা। প্রত্যাশা করব, ভবিষ্যতে এমন হত্যাকা- আর ঘটবে না। আশাবাদী লেখক এরপর অদ্ভুত সুন্দর উচ্চারণ করে বলেন, চিন্তা রক্তবীজের মতো। কেউ একটা চিন্তাকে নিহত করবে, সেই চিন্তা থেকে দশটা চিন্তা উঠে আসবে। আগুনপাখির মতো। ইটস লাইক এ ফিনিক্স। মৃতকে আর জীবিত করতে পারব না। কিন্তু নতুন নতুন মুখও তো আসছে। তাঁরা লিখছে। নতুন যাঁদের দেখছি, এঁদের তো আগে দেখিনি, এঁরা এগিয়ে আসছে। পতাকা হাত থেকে হাতে এগিয়ে চলেছে। এটিই হচ্ছে বড় কথা। মানুষ বড় কথা নয়। আমিও তো দুদিন বাদে চলে যাব। বাংলা সাহিত্য পরে থাকবে? রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার পর কি বাংলা সাহিত্য বন্ধ থেকেছে? কেউ কি বলেছে, এত বড় কবি চলে গেছে, আর লিখব না? নতুন বই ॥ মেলার তৃতীয় দিনেও এসেছে অনেক নতুন বই। শুধু বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমাপড়া বইয়ের সংখ্যা ৬৩। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৩, উপন্যাস ১২, প্রবন্ধ ৪, কবিতা ১০, গবেষণা ২, মুক্তিযুদ্ধ ২, ছড়া ২, শিশু সাহিত্য ৬, জীবনী ১ ও ইতিহাস বিষয়ে লেখা ১টি বই রয়েছে। মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ মেলামঞ্চের আয়োজনে বুধবার ঢুকে গিয়েছিল অন্য আয়োজন। একাডেমি আয়োজিত কবিতা উৎসবের একটি অংশ স্থানান্তরিত করে এখানে নিয়ে আসা হয়। বিকেলে মেলার মূলমঞ্চে কবিতা পাঠ করেন সুইডেনের কবি র্লাস হেগার, লত্তে সেদেরহোলম, ভারতের কবি রাসবিহারী দত্ত ও আনসার উল হক, বাংলাদেশের কবি রুবী রহমান, কবি আলতাফ হোসেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহাম্মদ সামাদ, আনোয়ারা সৈয়দ হক, অসীম সাহা, জাহিদুল হক, শিহাব সরকার, আসলাম সানী, তারিক সুজাত, টোকন ঠাকুর এবং পিয়াস মজিদ। এই অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। সভাপতিত্ব করেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অধিবেশন সঞ্চালনা করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। সভাপতির বক্তব্যে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, অমর একুশে এবং বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব আয়োজন করে বাংলা একাডেমি বিভিন্ন মহাদেশের কবিদের মেলবন্ধনের সুযোগ করে দিয়েছেন। কবিতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ভাষার শব্দশিল্পীরা মানুষের ভিতর স্বপ্নের পলি ও নুন সঞ্চার করে চলেছেন। এ স্বপ্ন সত্য হলে পৃথিবীও হয়ে উঠবে সব মানুষের যথাযথ বাসযোগ্য। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের শিল্পীরা।
×