ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশে প্রতিবছর ২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দেশে প্রতিবছর ২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ দুরারোগ্য ব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু ফারজানা আক্তার (৫)। শেরপুর জেলা সদরের নয়াপাড়া লসমানপুর গ্রামে তার বাড়ি। বর্তমানে সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। শিশুটির পিতা-মাতার পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা খারাপ। শিশুটির পিতা মোঃ ফারুক হোসেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। চিকিৎসার পেছনে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারটি। বর্তমানে টাকার অভাবে যে কোন সময় থেমে যেতে পারে শিশুটির চিকিৎসা কার্যক্রম। শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। এভাবে টাকার অভাবে শিশু ফারজানা আক্তারের মতো অসংখ্য ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা করাতে না পেরে তাদের কেউ কেউ অকালে মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করে। পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে ধরা হয়। দেশে বিভিন্ন ক্যান্সারে মৃত্যুহার অন্য সব দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ১৪ লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিবছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ২ লাখ মানুষ। বর্তমানে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যু হার শতকরা ৮ ভাগ। আগামী ২০৩০ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ ভাগ হবে। সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু তাই নয়, বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। দক্ষ চিকিৎসক আছেন, ওষুধ আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করিয়েও ব্লাড ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না আক্রান্ত রেশমী আক্তার। গত বছরের এপ্রিলে তার বিয়ে হয়। অসুস্থ হলে তাকে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে তার ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন চিকিৎসকরা। টাকার সঙ্কটে বর্তমানে তিনি গ্রামের বাড়িতে আছেন। কেমোথেরাপি দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকার নবাবগঞ্জ থানাধীন চুইরান গ্রামে তার বাড়ি। দেশের বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর আর্থিক সামর্থ্য নেই রেশমী আক্তারের পিতা মাতার। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত জোৎস্না আরা বেগম (৪৩)। তার শিশু সন্তান মোঃ শাদমান সাকিনও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালে মারা যায়। চিকিৎসকদের পরামর্শে জোৎস্না বেগমকে ভারতের টাটা মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে প্রায় দেড় বছর ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয়েছে নিজেদের সঞ্চিত, আত্মীয় স্বজন, শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৫২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ধার ও ঋণের টাকাও রয়েছে। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে জোৎস্না আরা বেগমকে। আরও ছয় মাস চিকিৎসা অব্যাহত রাখলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারটি। অসহায় হয়ে পড়েছেন জোৎস্নার স্বামী একরাম উদ্দিন। বর্তমানে টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। এভাবে শুধু জোৎস্না আরা বেগম নন, দেশে হাজার হাজার ক্যান্সার রোগী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। চিকিৎসার পেছনে সহায় সম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েও এই মরণব্যাধি থেকে রেহাই পাচ্ছে না তারা। স্বাাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় হাজার হাজার ক্যান্সার রোগী অকালে মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে রোগীর পরিবার। পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে ধরা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। পৃথিবীতে যত মৃত্যু হয় তার প্রায় শতকরা ১৩ ভাগ ঘটে ক্যান্সারের কারণে। প্রতি বছর ফুসফুসের ক্যান্সারে ১৩ লাখ, পাকস্থলীর ক্যান্সারে ৮ লাখ, মলদ্বারের ক্যান্সারে ৬ লাখ ৩৯ হাজার এবং স্তন ক্যান্সারে মারা যায় ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ। আর বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৮ জন আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩ জন। দেশে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ ও মুখগহ্বর ক্যান্সার (জিহ্বা, মাড়ি, ঠোঁট, মুখ ইত্যাদি ক্যান্সার), স্বরনালি ক্যান্সার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে জরায়ু মুখের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারেও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায়। ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান মৃত্যু রোধকল্পে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নামে এক নীতি প্রণয়ন করে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোয়াররফ হোসেন জানান, ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ। প্রতিবছর এই রোগে বিশ্বব্যাপী ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায় যাদের অর্ধেকেরই মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে। ক্যান্সার রোগের ভয়াবহতা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা মাথায় রাখলে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিয়ে উপায় নেই। ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু তাই নয়, বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ক্যান্সার সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। মন থেকে ক্যান্সার ভীতি দূর করতে হবে। ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। দক্ষ চিকিৎসক আছেন, ওষুধ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ মোয়াররফ হোসেন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারের জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ আটটি মেডিক্যাল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অল্পস্বল্প যন্ত্রপাতি দিয়ে ১২ থেকে ১৩ লাখ ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। আর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে শয্যাসংখ্যা ১৫০। গড়ে প্রতিদিন বহিঃবিভাগে ৫০ জন নতুন রোগী, ৪ থেকে ৫শ’ পুরনো রোগী আসে। বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় ১ লাখ রোগী। প্রতি ১০ লাখে একটি সেন্টার থাকা বাঞ্ছনীয়, সে হিসাবে গোটা দেশে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার ১৬০টি, আছে মোট ২০টি কেন্দ্র। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ দুটি কোবাল্ট মেশিন ও ১টি লিনিয়ার এসকেলেটর সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চালাচ্ছে। প্রতিদিন পৌনে ৩শ’ রোগী রেডিওথেরাপি নেয়, বহিঃবিভাগে প্রতিদিন ১শ’ জন রোগী আসে, ১০ থেকে ১৫ জন ডে-কেয়ারে সেবা নেয়। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক পারভীন সাহিদা আক্তার জানান, ক্যান্সারের চিকিৎসায় রোগীর জন্য বিপুলসংখ্যক নার্সের প্রয়োজন হয়। অথচ তাদের হাসপাতালে চিকিৎসকের চেয়ে নার্সের সংখ্যা কম। তিনি আরও বলেন, লিনিয়াক এসকেলেটর দামি যন্ত্র। এর পরিবর্তে কম মূল্যে কোবাল্ট মেশিন কিনে জেলা শহরগুলোয় চিকিৎসাসেবা দেয়া যতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ঢাকায়। তারাও নিয়মিতভাবে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন। আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার এ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, জানা-অজানা দুইভাবেই দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। আক্রান্তের ১৬ ভাগই এ ক্যান্সারে ভোগেন। এছাড়া পুরুষদের মধ্যে মুখগহ্বরের ক্যান্সার এবং শ্বাসনালীর ক্যান্সারে আক্রান্তের হারও বেশি। নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ু মুখের ক্যান্সারে বেশি। মরণব্যাধি এই রোগে আক্রান্তের ২৪ ভাগই ভোগেন এ ক্যান্সারে। এছাড়া স্তন ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্তের হারও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ক্যান্সার নিয়ে কাজ করে এমন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন মাত্র একশ জনের মতো। অনকোলজিস্ট নার্স নেই। রয়েছে পর্যাপ্ত চিকিৎসার যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতাও। দেশে ক্যান্সারের বিস্তার আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকলেও চিকিৎসা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে এখনও রাজধানী বা বড় বড় শহরের বাইরের রোগীরা বঞ্চিত রয়েছেন।
×